দর্পণ ডেস্ক : লালগ্রহে পোকা? তাও আবার ডানাওয়ালা, ছ’পা সন্ধিপদ প্রাণী।সরীসৃপও রয়েছে। বহু বছরের খোঁজ কি তবে শেষ হল? সত্যিই কি প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে মঙ্গলে!

এতগুলো প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনই মিলবে কি না জানা নেই, তবে লালগ্রহের মাটিতে সন্ধিপদ প্রাণীদের জীবাশ্মের সন্ধান মিলেছে এ কথা হলফ করে জানিয়েছেন আমেরিকার ওহিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্টোমোলজিস্ট অধ্যাপক এমিরেটাস উইলিয়াম রোমোসা। মঙ্গলযান মিস কৌতূহলের (Curiosity Rover) তোলা একাধিক ছবির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে রোমোসা বলেছেন, মঙ্গলের মাটিতে ফসিল হয়ে আছে কিছু পতঙ্গের কঙ্কাল। সেই জীবাশ্মের গঠনে ফুটে উঠেছে এক জোড়া ডানার মতো আকার, মাথা-বুক-উদরের মতো গঠন। একজোড়া শুঁড়ও ঠিল সেই দেহে এটাও স্পষ্ট। এর থেকেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে হয়তো একসময় লালগ্রহের মাটিতে চলে ফিরে বেড়াত এরা।

মার্কিন বিজ্ঞানী রোমোসার পর্যবেক্ষণ রয়েছে আরও। তার কথায়, ‘‘পোকামাকড়ের জীবাশ্ম এটাই প্রমাণ করে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল মঙ্গলে। একটা নির্দিষ্ট জায়গা জুড়ে কিউরিওসিটি রোভারের তোলা কিছু ছবির বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি ঠিক পতঙ্গের মতোই দেহের অংশের জীবাশ্ম ছড়িয়ে রয়েছে মঙ্গলের মাটিতে। শুধু সন্ধিপদ নয়, সরীসৃপ জাতীয় কোনও প্রাণীর জীবাশ্মও রয়েছে। বিশদে গবেষণা করলে এইসব প্রাণী সম্পর্কে আরও ভালভাবে বলা সম্ভব হবে।’’

মার্কিন বিজ্ঞানীদের এই পর্যবেক্ষণ ‘এন্টোমোলজিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকা’র ন্যাশনাল কনফারেন্সে প্রথম জানানো হয়। মঙ্গলে পোকা মিলেছে, এই খবর ছড়াতেই হুড়োহুড়ি পড়ে যায় বিজ্ঞানীমহলে। তবে রোমোসার পর্যবেক্ষণের সত্যতা নিয়ে দ্বিমত তৈরি হয়েছে। অনেক বিজ্ঞানীরাই বলেছেন মঙ্গলের মাটিতে দৃষ্টিভ্রম আগেও অনেকবার হয়েছে। লাল গ্রহের উত্তরে জমাট পুঞ্জীভূত মেঘ দেখে মনে হয়েছে জলের ধারা। মঙ্গলে দেখা যায় একরকম, কিন্তু বাস্তবে সেটা একেবারেই আলাদা। লাল গ্রহের যে জায়গার মাটিতে এমন জীবাশ্মের ছবি উঠেছে বলে বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, সেখানকার আরও পরিষ্কার ছবি দরকার। তবেই রহস্যের উদঘাটন সম্ভব।

মঙ্গলে রহস্যভেদ করার চেষ্টা বহু বছর ধরেই করছে রাশিয়ার ROSCOSMOS, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসা (NASA) এবং ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সির (ESA) মতো মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। সেই তালিকায় যোগ হয়েছে ইসরোর Mars Orbiter Mission (MOM) ।

১৯৭২ সালে মঙ্গলযাত্রার সূচনা করেছিল নাসা-র মেরিনার-৯ অরবিটার। মঙ্গলের অজস্র ছবি তুলে এক অচেনা জগতের দ্বার উন্মোচিত করেছিল। তার পর থেকেই মঙ্গল-অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা বিশ্ব। এখনও অবধি তিন রকমের মঙ্গল-অভিযান হয়েছে। এক, ফ্লাই বাই (মঙ্গলের ‘পাশ’ দিয়ে চলে যাওয়া); দুই, অরবিটার (মঙ্গলের কক্ষপথে ঘোরা); তিন, ল্যান্ডার/ রোভার (মঙ্গলে অবতরণ ও সফর করা)। ইসরোর মঙ্গলযান আসলে অরবিটার। কক্ষপথে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করাই এর কাজ। ‘মম’-এর শীরে বসানো পাঁচটি যন্ত্র—মিথেন সেন্সর (MSM), মার্স কালার ক্যামেরা (MCC), লেম্যান অলফা ফোটোমিটার (LAP) মার্স এক্সোফেরিক নিউট্রাল কম্পোজিসন অ্যানালাইজার (MENCA), থার্মাল ইনফ্র্যারেড ইমেজিং স্পেকট্রোমিটার (TIS) মঙ্গলের মাটির গঠন, চরিত্র, আবহাওয়ার প্রকৃতি, বাতাসে মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব, বাযুম্ডলে অ-তরিদাহত কণার গবেষণা চালাচ্ছে। মঙ্গলযান ‘মম’ দেখিয়েছে, মঙ্গলে দিন-রাত আছে, ঋতু পরিবর্তন আছে, আছে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু, খুব উঁচু পাহাড় আছে, বিরাট আগ্নেয়গিরি আছে, বিশাল নদীখাতও আছে, যা একদা সেখানে জল থাকার প্রমাণ দেয়।

পৃথিবীর থেকে মঙ্গলের ঠান্ডা অনেকটাই বেশি। তাপমাত্রা কম-বেশি মাইনাস ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। এই মারাত্মক ঠান্ডায় বরফ গলে জল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। গবেষকরা জানাচ্ছেন, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের যেহেতু বেশির ভাগটাই উড়ে গিয়েছে (মঙ্গলের অভিকর্ষ বল অনেক কম বলে), তাই তার বায়ুমণ্ডল খুব পাতলা। ফলে, সূর্যের তাপে পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি তেতে ওঠে ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলের পিঠ। তাই যদি সামান্যতম জলও থাকে মঙ্গলের পিঠে, তা হলেও খুব তাড়াতাড়ি তা উবে যাবে। সেই উবে যাওয়া জল উপরে উঠে জমে গিয়ে বরফ হয়। সেই বরফের টুকরোগুলো মঙ্গলের মেঘে ভেসে বেড়ায়।