মো. শাহাগির মৃধা, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : সরাইল উপজেলার পাকশিমুল ইউনিয়নের তিতাস নদী তীরবর্তী জয়ধরকান্দি এলাকায় ড্রেজার দিয়ে চলছে নদী খননের কাজ। এখানে নদী খননের এ কাজে দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
নদী খনন কাজে সরাসরি আনুষ্ঠানিক কোনো অনিয়মের অভিযোগ না থাকলেও এই নদী খনন কাজকে পুঁজি করে অনৈতিক উপায়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম শুধু জয়ধরকান্দি গ্রামের নানা পেশাজীবী মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত এক কোটি এগারো লাখ টাকা।
শনিবার সরেজমিন জয়ধরকান্দি গ্রামবাসী ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকদের সাথে আলাপ করে জানা যায়,
নাব্যতা হারিয়ে মেঘনা কন্যা খ্যাত তিতাস নদী জরাজীর্ণ খালে পরিণত হয়। দিন দিন প্রভাবশালীদের দখল আর দূষণের কারণে স্থবির হয়ে পড়ে তিতাস নদীর স্বাভাবিক স্রোতধারা।
অবশেষে ঐতিহ্যবাহী এ নদীটি খনন করে নদীকে তার হারানো যৌবনে ফেরানোর উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকার। তিতাস নদী খননের জন্য ইতিমধ্যে ১৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। গত ১৩ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এ নদীর খনন কাজ। বাংলাদেশ নৌবাহিনী এ খনন কাজের দায়িত্ব নেয়। জেলার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর এলাকা থেকে এ খনন কাজ শুরু হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত প্রায় সাড়ে তিন মাস যাবত জয়ধরকান্দি অঞ্চলের তিতাসের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদী খননের কাজ চলছে। এ সুযোগে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এ নদী খনন কাজের সরাসরি বাস্তবায়নের সাথে জড়িত অসাধু ব্যক্তিদের সাথে একটি অনৈতিক চুক্তি করে। তারা খননকাজে নদী থেকে উত্তোলন করা মাটি ও বালু নদী তীরবর্তী বসবাসকারী মানুষদের কাছে বিক্রি করে অনেক কৃষি জমি ভরাটের পর বসতভিটা করার মাধ্যমে ফায়দা লুটে কোটি টাকার উপরে।
প্রতি শতাংশ জমি মাটি ভরাট বাবদ ইউপি চেয়ারম্যান নিচ্ছেন তিন হাজার টাকা করে। এই পর্যন্ত গ্রামের বিভিন্ন মানুষের কৃষি আবাদি জমিসহ নানা প্রকার অন্তত তিন হাজার ছয় শত পঞ্চাশ শতাংশ জমি ভরাটের চুক্তি করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম। এতে তার অর্থ বাণিজ্য প্রায় এক কোটি এগারো লাখ টাকা। আর ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে চুক্তি করা লোকদের কাছ থেকে এসব টাকা তাগাদা দিয়ে উত্তোলন করছেন জয়ধরকান্দি গ্রামের কবিরাজ কালা মিয়া এবং মো. খলিল মিয়া নামে এই দুই ব্যক্তি।
স্থানীয় লোকজন জানান, তিতাস নদী শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্য নয় এটি সারাদেশেই বিখ্যাত। এ নদীর খনন কাজ শেষ হলে নদী ফিরে পাবে তার স্বাভাবিক স্রোতধারা এবং স্থানীয়দের সেচের সুযোগ-সুবিধা তৈরি হবে। তবে এই নদী খনন কাজকে পুঁজি করে ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন। এ কাজে স্থানীয় প্রশাসনের তদারকি না থাকার কারণে ইউপি চেয়ারম্যান এইখানে প্রভাব খাটিয়ে এই অনৈতিক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন বীরদর্পে।
এই বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে জয়ধরকান্দি গ্রামের বাসিন্দা কবিরাজ কালা মিয়া বলেন, আমরা টাকা উঠিয়ে চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের কাছে দেই। তিনি ২০ লাখ টাকার পাইপ কিনে এনে গ্রামের বিভিন্ন মানুষের জমি, নদী খননের মাটি-বালু দিয়ে ভরাট করে দিচ্ছেন। চুক্তি থাকলেও সবাই শতাংশ হিসেবে তিন হাজার টাকা দেই না, কিছু কমও দেই। যার কারণে চেয়ারম্যান সাহেব এখন লোকসানে আছেন। আমি এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা তুলে চেয়ারম্যানের হাতে দিয়েছি। আমি এক সাইডের টাকা তোলার দায়িত্বে আছি। অন্য সাইডে আরো লোক আছে, সেইটা চেয়ারম্যান জানেন।
এ কাজে নিয়োজিত জয়ধরকান্দি গ্রামের মো. খলিল মিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, তালিকা অনুযায়ী টাকা তুলে চেয়ারম্যানকে দেই। তিনি টাকা-পয়সা খরচ করে এই নদী খনন কাজ এনেছেন। তাছাড়া অনেক পাইপ কিনে তিনি নদী খননের মাটি ও বালু দিয়ে মানুষের কৃষি জমি ভরাট করিয়ে ভিটিবাড়ি তৈরী করে দিচ্ছেন। তাই চেয়ারম্যান সেইসব মানুষদের কাছ থেকে শতক হিসেবে টাকা নিচ্ছেন। তবে অনেকে চুক্তি অনুযায়ী টাকা না দিয়ে, এখন কিছু টাকা কম দিচ্ছে।
খলিল মিয়া বলেন, আমরা কমিশন ভিত্তিতে কাজ করি। কিছুদিন পর পর পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা করে পাই। চেয়ারম্যান সাব বলেছেন সব টাকাগুলো উঠে আসলে হিসেব করে আমাদের পাওনা তিনি দিয়ে দিবেন।
যোগাযোগ করা হলে পাকশিমুল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, তিতাস নদীর ১০৯ কিলোমিটার খননকাজের মধ্যে অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকা আমার ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে।
এখানে ড্রেজার দিয়ে নদী খননে যেই বালু-মাটি তোলা হচ্ছে, তা এলাকার মানুষেরা নিজস্ব খরচে নিয়ে তাদের নিঁচু জায়গা ও জমি ভরাট করছে।
এসব জমি ভরাটে আপনি প্রতি শতাংশে তিন হাজার টাকা করে নিচ্ছেন এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম প্রথমে মুঠোফোনের কল লাইনটি কেটে দেন। পরে দুইদফা কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে অন্তত ৩০ মিনিট পর ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম নিজেই তার মুঠোফোনের মাধ্যমে কল দিয়ে এ প্রতিবেদককে প্রস্তাব দেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি সরাসরি বসতে চান এবং এ নিয়ে কোন রিপোর্ট না করার অনুরোধ করেন।
এ বিষয়ে সরাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ এস এম মোসা বলেন, এই নদী খনন কাজের ব্যাপারে কোনো কিছুই সংশ্লিষ্টরা স্থানীয় প্রশাসনকে অবগত করছে না। তারা মাটি বিক্রি করতে গিয়ে সেখানে নদীর পরিবর্তে সরকারি একটি খাল খনন শুরু করে। খবর পেয়ে আমি সার্ভেয়ার পাঠিয়ে সেই খালের খনন কাজ বন্ধ করি। ইউএনও আক্ষেপ করে বলেন, তাদেরকে বলেছিলাম জনস্বার্থে সেখানকার একটি মাঠে ও একটি গর্তে কিছু মাটি-বালু ফেলে ভরাট করে দিতে। কিন্তু তারা এ কথা শুনেনি। অথচ নদী খননের এসব মাটি-বালু তারা বিভিন্ন মানুষের কাছে বিক্রি করছে, এসব কথা প্রায়ই সেখানকার অনেকেই আমাকে জানিয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর মুঠোফোনে কয়েকদফা যোগাযোগ করা হয়। মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।