রৌদ্রকরোজ্জ্বল চেতনার প্রতিভূ

‘একটি শব্দ ধ্রুবপদের মতো ফিরে ফিরে তাঁর সম্পর্কে ব্যবহার করেন পরিচিত ও অন্তরঙ্গরা। শব্দটি ছোট কিন্তু তার অর্থ-আয়তন অভিধানের বড় বড় শব্দের থেকে অনেক ব্যাপক। শব্দটি ‘অনন্য’। তাঁরা বলেন, ডক্টর আহমদ শরীফ অনন্য। এমন আর নেই, আর পাওয়া যাবে না পলিমাটির এই ছোট ব-দ্বীপে। দ্বিতীয় নেই, তৃতীয় নেই, চতুর্থ নেই তাঁর।’
-হুমায়ুন আজাদ

হুমায়ুন আজাদ তার জীবদ্দশায় কখনও কাউকে এমন নিরঙ্কুশ শ্রদ্ধা মাখানো ব্যাখ্যা করেননি। একমাত্র আহমদ শরীফের বেলায় এসে হুমায়ুন আজাদকেও সংযত হতে হয়েছে। না, তিনি ভয়ে কিংবা অন্য কোনো জড়তা বা দ্বিধা থেকে সংযত হননি। সংযত হয়েছেন শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞতায়।

শুধু হুমায়ুন আজাদ নন; বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের চূড়ান্ত সময় পর্যন্ত আহমদ শরীফের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। তিনি জড়িয়ে আছেন এই দেশের জন্মের সাথে, ইতিহাসের সাথে, ভাষার সাথে, সাহিত্যের সাথে। জড়িয়ে আছেন আন্দোলন, সাহস, সুন্দর ও শুদ্ধতার সাথে। তিনি ছিলেন অসামান্য, অকপট, অভ্রান্ত। কথা, কাজ ও জীবনকে এক রেখে যাপন করা এত সহজ কাজ নয়। এই কঠিন কাজটি তিনি করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। তার নীতি, আদর্শ ও চারিত্রিক দৃঢ়তার সামনে ঘোরতর শত্রুও সম্মতি ও স্বীকারের ইশারা নিয়ে হাজির হতো।

১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমুদ্রতীরবর্তী পটিয়ার সুচক্রদ ী গ্রামে আহমদ শরীফের জন্ম। তার বাবা আবদুল আজিজ ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের কেরানি। মা সিরাজ খাতুন ছিলেন গৃহিণী। আবদুল আজিজ ও সিরাজ খাতুনের পাঁচ সন্তান। আহমদ শরীফ ছিলেন চতুর্থ। ১৯৪৬ সালে পিতা আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর তিনি ফুফু ও ফুফার সাথে বসবাস শুরু করেন। তখন তার বয়স ২৫ বছর। আহমদ শরীফের ফুফুর নাম বদিউন্নিসা এবং ফুফা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত গ্রন্থাগার। ফুফার সান্নিধ্যে এসে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে নতুন করে যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। এই যোগাযোগের মাঝেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন তিনি।

আহমদ শরীফ বড় হয়ে উঠেছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের দুর্লভ অমূল্য পুঁথির ভাণ্ডার ও সাময়িক পত্রপত্রিকার সম্ভারের মধ্যে। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় তিনি ব্যয় করেছেন মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য, যা ইতিহাসের অন্যতম দলিল। বিশ্নেষণাত্মক তথ্য, তত্ত্ব ও যুক্তিসমৃদ্ধ দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস বাংলাভাষী মানুষকে দিয়ে গেছেন, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর গাথা হয়ে থাকবে।

ভাববাদ, মানবতাবাদ ও মাকর্সবাদের যৌগিক সমন্বয় প্রতিফলিত হয়েছিল তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ এবং বক্তব্য ও লেখনীতে। তার রচিত শতাধিক গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোতে তিনি অত্যন্ত জোরালো যুক্তি দিয়ে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, বিশ্বাস ও সংস্কার পরিত্যাগ করেছিলেন।

পঞ্চাশ দশক থেকে নব্বই দশকের শেষাবধি সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাসসহ অনেক বিষয়ে তিনি অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। দ্রোহী সমাজ পরিবর্তনকারীদের কাছে আজও তার পুস্তকরাশির জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। ১৯৬৫ সালে তার লেখা ‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালি’ প্রবন্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটির কথা উল্লেখ ছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকে তার মৃত্যু অবধি তিনি দেশের সব ক্রান্তিলগ্নে কখনও একক, কখনও সম্মিলিতভাবে তা প্রশমনে মুক্ত মনে এগিয়ে এসেছিলেন। উপমহাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অসামান্য পি ত, বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক যুক্তিবাদী, দার্শনিক, বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, মুক্তবুদ্ধি ও নির্মোহ চিন্তার এক অনন্য ধারক ছিলেন ড. আহমদ শরীফ।