পাচার ও মজুদে বিপন্ন পাট খাত। টনে টনে পাট পাচার হচ্ছে পাশের দেশগুলোতে। পাচার হওয়া পাটের প্রধান গন্তব্য মিয়ানমার। বাকিটা যাচ্ছে ভারতে। অবৈধ এই পথ অবারিত থাকায় হঠাৎ করেই পাটের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। প্রতিদিন বাড়ছে পাটের দাম। যদিও প্রান্তিক কৃষক পাটের এই দ্বিগুণ দাম পাচ্ছেন না। সপ্তাহের ব্যবধানে মণপ্রতি দাম বেড়েছে দেড়শ’ থেকে ২০০ টাকা। মৌসুমের এক হাজার টাকার পাট এখন দুই হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কাঁচাপাটের বড় একটা অংশ পাচারের পাশাপাশি চলছে অবৈধ মজুদদারি। এই দ্বিমুখী সংকটে নাজুক অবস্থায় পড়েছে পাটশিল্প। একদিকে কাঁচাপাটের সংকটে পাটকলগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে বেশি দামে কেনা পাটে উৎপাদিত পণ্যও রপ্তানি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। নতুন করে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে রপ্তানি চুক্তি প্রায় বন্ধ।
কৃষকের হাতে থাকা মৌসুমের পাট শেষ হওয়ার পরই অস্বাভাবিক হারে এই দাম বাড়লো। এ কারণে পাচারকারী ও অসাধু মধ্যস্বত্বভোগীরা বাড়তি দামের ফায়দা লুটছে। এতে পাটচাষি ন্যায্য দর থেকে বঞ্চিত হলেন। শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে বেকার। লোকসানের মুখে পুঁজি হারাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। খুঁড়িয়ে চলা পাটশিল্পের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এ ধরনের ছলচাতুরী কৃষি, শিল্প, কর্মসংস্থানসহ জাতীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে জাতীয় পাট দিবস। অর্থনীতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের সম্ভাবনা ও বিকাশে উৎসাহ জোগানো এবং পাটচাষি, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, কর্মকর্তাসহ সংশ্নিষ্টদের কার্যক্রমে সমন্বয় বাড়ানোই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘সোনালী আঁশের সোনার দেশ, মুজিববর্ষে বাংলাদেশ’।
দিবস উপলক্ষে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার বাড়াতে পাট এবং পাটপণ্যের বাজার বাড়াতে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে। এবারের দিবসের প্রধান আয়োজনের মধ্যে রয়েছে, দেশের সব জেলায় পাট র্যালি ও আলোচনা সভা, বহুজাতিক পাটপণ্যের মেলা, পাটে অবদানের জন্য সম্মাননা এবং সচিবালয়, শাপলা চত্বর, দোয়েল চত্বরসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সড়কদ্বীপে সাজসজ্জা এবং আলোকসজ্জা করা। শুক্রবার সকালে সচিবালয় থেকে র্যালির মাধ্যমে দিবসের কার্যক্রম শুরু হবে। অফিসার্স ক্লাব পর্যন্ত র্যালিতে নেতৃত্ব দেবেন পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। অফিসার্স ক্লাবেই পাঁচ দিনের বহুমুখী পাটপণ্যের মেলা বসছে। পাট দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাটের পরিবেশ ও বাণিজ্য সমৃদ্ধি নিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো।
এবারের আয়োজন নিয়ে দেশে তৃতীয়বারের মতো জাতীয়ভাবে পাট দিবস পালিত হচ্ছে। পাটের সঙ্গে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির বিবেচনায় ২০১৬ সালে প্রতিবছর ৬ মার্চ জাতীয়ভাবে পাট দিবস আয়োজনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরের বছর থেকে প্রতিবছর দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, দুঃখজনক এই পরিণতির জন্য সরকার ও বেসরকারি মিল মালিক দু’পক্ষই দায়ী। সমকালকে তিনি বলেন, সরকারের বাণিজ্যনীতি যুক্তিসঙ্গত নয়। আগে থেকেই রপ্তানির সুযোগ থাকলে প্রতিযোগিতামূলক দরের সুফল হিসেবে পাটের বেশি দর পেতেন কৃষক। আবাদেও তারা আরও উৎসাহিত হতেন। এতে উৎপাদন বাড়ত। সরকার সে পথে যায়নি। বরং ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার জন্য কখনও রপ্তানির সুযোগ অবারিত করা হয়, আবার তাদের পরামর্শে বন্ধ করে দেওয়া হয়। উদ্যোক্তাদের দায়ী করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে পাটের দাম কম দেওয়ার একটা প্রবণতা সব সময়ই আছে। কৃষককে ঠকিয়ে তারা মুনাফা করতে চান। কৃষকের কাছ থেকে কিনে পাচারের ব্যয় মিটিয়েও মুনাফা করা সম্ভব বলেই তো পাট পাচার হচ্ছে। এখন বিদেশিরা যদি বেশি দামে পাট কিনে মুনাফা করতে পারে তাহলে দেশের উদ্যোক্তাদের মুনাফা করতে সমস্যা কোথায়। এ বিষয়গুলো পরিস্কার বোঝার পর যুক্তিসঙ্গত বাণিজ্য নীতি নিতে হবে। সেটা করা সম্ভব না হলে সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না।
পাট পাচার এবং মজুদদারির তথ্য দিয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর কাছে চিঠি দিয়েছে বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ)। জরুরি ভিত্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ চাওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা না গেলে পাটের সংকট ও অস্বাভাবিক বেশি দরের কারণে পাটকলগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। এতে বেসরকারি পাট খাতেও শ্রমিক অসন্তোষ, বেকারত্ব ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
চিঠিতে পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়, ইতিমধ্যে বৈধ ও অবৈধভাবে পাটের বড় একটা অংশ দেশের বাইরে চলে গেছে। কিছু মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যবসায়ী কাঁচাপাটের মজুদ ধরে রেখেছে। পাচার ও মজুদদারির কারণে পাটকলগুলোতে কাঁচাপাটের সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকটে পাটের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়েছে। প্রতি সপ্তাহে মণপ্রতি পাটের দর ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে বাড়ছে। অধিক মূল্যে পাট কিনে পণ্য তৈরি করে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে মিলগুলো। পাটের বেশি দরের কারণে বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের কাছে নতুন করে রপ্তানি আদেশের চুক্তি করা যাচ্ছে না। ফলে আর্থিক লোকসান প্রকট আকার ধারণ করেছে।
অভিযোগের বিষয়ে বিজেএমএর মহাসচিব আব্দুল বারেক খান সমকালকে বলেন, সরকারের কাছ থেকে এখনও কোনো জবাব বা প্রতিকার পাননি তারা। পাটের সংকটের কথা জানিয়ে মিলগুলো প্রতিদিনই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আবারও সরকারকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে নিম্নমানের পাটের নামে ভালো মানের পাট রপ্তানিরও অভিযোগ করেছে বিজেএমএ। এ বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, এ পর্যন্ত রপ্তানি হওয়া কাঁচাপাটের একটা বড় অংশই নিম্নমানের পাটের নামে রপ্তানি হয়েছে। অথচ দেশে নিম্নমানের পাটের উৎপাদন মোট পাটের ৩ থেকে ৫ শতাংশের বেশি নয়। বাংলা তোষা রিজেকশন (বিটিআর) এবং বাংলা হোয়াইট রিজেকশন (বিডব্লিউআর)। পাচার রোধে স্থলপথে পাট রপ্তানি বন্ধ রেখে শুধু সমুদ্রপথে রপ্তানির সুযোগ রাখার অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে।
পাট অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ৬ মাসে চার লাখ ৭৪ হাজার ৭০৭ বেল কাঁচাপাট রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে ডিসেম্বরে এক মাসেই রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮৬ লাখ বেল, যা প্রতি মাসের স্বাভাবিক হিসাবের তুলনায় অনেক বেশি। সংস্থার হিসাবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মজুদ পাটের পরিমাণ প্রায় ২৯ লাখ ৪৭ হাজার বেল। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে এই মৌসুমে পাট কেনার তথ্যের ভিত্তিতে এই মজুদ প্রতিবেদন করা হয়েছে। সরকারি পাটকলগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) সরকারি মিলগুলোর জন্য এজেন্সির মাধ্যমে পাট সংগ্রহ করে থাকে। বেসরকারি খাতে বিজেএমএ, বিজেএসএ, রপ্তানিকারক, পাক্কা বেলার ও কাঁচ্চা বেলাররা পাট ক্রয় করে।
সরকারি জুট মিলেও পাট সংকট চলছে। পাটের অভাবে উৎপাদন বন্ধ থাকছে। বসিয়ে বসিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিতে হচ্ছে বলে লোকসানের চাপে থাকা পাটকলগুলো আরও লোকসানে পড়বে। সরকারের নিয়োগ করা এজেন্সিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাচারের কারণে বাজারে এখন পাটের প্রকট সংকট। খুলনার খালিশপুর জুট মিলে পাট সরবরাহকারী মাগুরা অঞ্চলের সোনারবাংলা জুট এজেন্সির চেয়ারম্যান এনামুল হক হিরক গত অক্টোবরেই পাট পাচারের তথ্য সমকালকে জানিয়েছিলেন। গতকাল তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ বছর উৎপাদিত মোট পাটের অন্তত ৪০ শতাংশ ইতোমধ্যে পাচার হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাচার হয়েছে। সীমান্তে শিথিলতার সুযোগে বড় বড় ট্রাক পাট পাচারে ব্যবহার করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রউফ সমকালকে বলেন, অর্থের অভাবে এ বছর এখনও পাট ক্রয় কার্যক্রম শুরু করেনি সরকারি পাটকলগুলো। এ কারণে বাজারে পাটের কী ধরনের সংকট আছে সে বিষয়টি তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। পাট খাতের বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ পাওয়া গেলে পরবর্তী কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে।
পাচার ও মজুদের বিষয়ে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট সচিব লোকমান হোসেন মিয়া সমকালকে জানান, বিষয়টি যাচাই করে দেখা হবে। সমস্যা থাকলে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে পাটের এখন সুদিন চলছে। রপ্তানি খাতের সব পণ্যের তুলনায় পাটের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বেশি রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি হয়েছে ২২ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ৫১ কোটি ডলারের পাট ও পাটপণ্য।
পাট খাতের সংকটের কথায় বিজেএমএর সভাপতি মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারি সমকালকে বলেন, সরকারের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব না হলে বেসরকারি খাতের সব পাটকল বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, অন্য খাত থেকে টাকা এনে বছর বছর লোকসান দিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তার মতে, পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানি বাণিজ্যের ৮৫ শতাংশ হয় বেসরকারি খাতে। এই খাত বন্ধ হলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হবে। বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যাবে। সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে।
পাট খাতকে টিকিয়ে রাখতে অন্তত ৫টি পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে পাচার রোধে ব্যবস্থা হিসেবে শুধু সমুদ্র পথেই রপ্তানির ব্যবস্থা রাখা। মজুদ আইন অনুযায়ী, এক লাইসেন্সে এক হাজার মণের বেশি পাট মজুদ রাখা যাবে না। তিন মাসের বেশি মজুদ ধরে রাখা যাবে না। অর্থনীতি ও পরিবেশের স্বার্থে আন্তর্জাতিক বাজার খোঁজার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে চাহিদা সৃষ্টি করা। এজন্য আইন অনুযায়ী ১৯ পণ্যের মোড়কে পাটজাত মোড়ক বাধ্যতামূলক ব্যবহারের আইন কার্যকর করা। বর্তমানে এই আইনটি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বেসরকারি খাতের পাটকলের পুঁজির সংকট মোকাবিলায় মূল পুঁজির অন্তত ১৫ শতাংশ সরকারের পক্ষ থেকে জোগান দেওয়া। পাটশিল্পে সরকারের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ও বেসরকারি পাটকল উভয় খাতে সম এবং ন্যায্য হারে বণ্টন করা। এখন সরকারি পাটকলে ভর্তুকির কারণে বেসরকারি পাটকলগুলো বাণিজ্য বৈষম্যের মুখে নাকাল হচ্ছে।