লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুলের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর উল্লেখ করলেও জমা দিয়েছেন স্নাতক পাসের সনদ। বিদেশি একটি কলেজে যে বিষয়ে লেখাপড়ার কথা উল্লেখ করে স্নাতক পাসের সনদ জমা দিয়েছেন ওই কলেজে উল্লিখিত বিষয়ে পড়ানো হয় না। তার জমা দেওয়া সনদ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। পাপুলের হলফনামা খতিয়ে দেখে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই হলফনামার সঙ্গে পাপুলের জমা দেওয়া সনদ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করেছিলেন ওই সময়ে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল ফয়েজ ভূঁইয়া। ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর এই রিট মামলার শুনানির দিন ধার্য ছিল। বিশেষ কারণে ওই দিন এই মামলার শুনানি হয়নি। রিট মামলার বাদী আবুল ফয়েজ ভূঁইয়া বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। তার আইনজীবী মো. সালাউদ্দিন ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, শহিদ ইসলাম পাপুল শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে তার নির্বাচনী হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। তিনি হলফনামায় স্নাতকোত্তর উল্লেখ করে জমা দিয়েছেন স্নাতক সনদ। এই স্নাতক সনদটিও ভুয়া। প্রকৃতপক্ষে তিনি এসএসসি পাসও করেননি।
জানা গেছে, এমপি ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক পাপুলের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে গ্রাহকের নামে ঋণ বরাদ্দ, বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার ও শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার বিরুদ্ধে দুদকের পেশ করা অভিযোগে মানব পাচার করে এক হাজার চারশ’ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন; হুন্ডি, মানি লন্ডারিং, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণার নানা তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশন এ অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। দুদকের ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন। এমপি পাপুল বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। এই কারণে অভিযোগের বিষয়ে তার কোনো ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, পাপুল প্রতারণা, জালিয়াতি করে শুধু অবৈধ সম্পদই অর্জন করেননি। তিনি জালিয়াতি করে ভুয়া শিক্ষাগত সনদও জোগাড় করেছেন। তিনি সিয়েরা লিয়নের মিলটন মরগাই কলেজ অব এডুকেশন অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ব্যাচেলর অব সোশ্যাল সায়েন্স ইন ইকোনমিক্স বিষয়ে স্নাতক সনদ সংগ্রহ করেছেন। শিক্ষাবর্ষ ১৯৮৭। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, পাপুল যে বিষয়ের ওপর স্নাতক সনদ জোগাড় করেছেন কলেজটিতে ওই বিষয়ের ওপর কোনো ডিপার্টমেন্ট নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাপুল ২০১৬ সালে কুয়েত থেকে নিজ এলাকা লক্ষ্মীপুর ফিরে ‘লক্ষ্মীপুর২৪ডটকমে’ একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এটি প্রকাশ করা হয় একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর। সেখানে তিনি বলেছেন, ঢাকার তিতুমীর কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন ১৯৯২ সালে। সিয়েরা লিয়নের মিলটন মরগাই কলেজের নামে স্নাতক সনদ সংগ্রহ করেছেন ১৯৮৭ সালে। ১৯৯২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ও এর আগে ১৯৮৭ সালে স্নাতক পাসের তথ্যের এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ হিসাব তাকে বিতর্কিত করেছে। নিউইয়র্ক সিটি কলেজে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছেন বলে ওই সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে পাপুল ছিলেন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। ওই সময় এই আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী ছিলেন মোহাম্মদ নোমান। ওই সময় মোহাম্মদ নোমানকে বসিয়ে দিয়ে পাপুল আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে যান। এরপর আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়কারী ড. সেলিম মাহমুদের স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতির সঙ্গে পাপুলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। হঠাৎ করে কুয়েত থেকে এসে টাকার জোরে দলের এমপি হয়ে গেছেন। এ নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে।
সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পাপুল যুদ্ধাপরাধের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাসেম আলীর মালিকানাধীন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার। এর মধ্যে রয়েছে দিগন্ত মাল্টিমিডিয়া করপোরেশন, দিগন্ত টেলিভিশন, দৈনিক নয়া দিগন্ত ও দিগন্ত পেপার মিলস।
পাপুলের বিরুদ্ধে দুদকে পেশ করা অভিযোগে বলা হয়, তিনি কুয়েতে মানব পাচার করে ১ হাজার চারশ’ কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেছেন। বিদেশে ব্যবসার আড়ালে মানব পাচারই তার মূল কাজ। হুন্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের কথা বলা হয়েছে। তার একান্ত কাছের ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে ও হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অবৈধভাবে অর্জিত ২৮০ কোটি টাকা দেশে আনেন ২০১৬ সালে।
অভিযোগে পাপুলের নামে-বেনামে সম্পদের বর্ণনা
অভিযোগে বলা হয়, পাপুল পঞ্চাশ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয় করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক হন। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে তার স্ত্রী সংরক্ষিত ৪৯ নম্বর মহিলা আসনের এমপি কাজী সেলিনা ইসলামের নামে রয়েছে ৩০ কোটি টাকার শেয়ার। রাজধানীর গুলশান-১ এলাকার পোস্ট অফিসের কাছে ১৬/এ রোডে অবস্থিত গাউছিয়া ডেভেলপমেন্ট হাউজিং কোম্পানির কাছ থেকে কেনা দুটি ফ্ল্যাটের মধ্যে একটি তার বড় মেয়ের নামে, অন্যটি স্ত্রীর নামে। গুলশান-২ এ পিংক সিটির পেছনে গাউছিয়া ইলিমিয়াতে ৯ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট স্ত্রীর নামে কিনেছেন প্রায় ৩০ কোটি টাকায়।
এছাড়া স্ত্রীর নামে মেঘনা উপজেলায় ৯১ কোটি টাকার জমি, স্ত্রীর নামে সোনালী ব্যাংক থেকে ৫০ কোটি টাকার ওয়েজ আনার্স বন্ড ক্রয়, বড় মেয়ে ওয়াফা ইসলামের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে ২০ কোটি টাকার ওয়েজ আনার্স বন্ড ক্রয়, স্ত্রীর ছোট বোন জেসমিন ইসলামের নামে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফোর্স হাই ডিপ ও টয়োটা করোলা গাড়ি ক্রয়, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে স্ত্রীর স্থায়ী আমানত ৪০ কোটি টাকা, নিজ নামে ১০ কোটি টাকার, বড় মেয়ে ওয়াফা ইসলামের নামে ২৫ কোটি টাকার, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় স্ত্রীর নামে ৬ তলা বাড়ি রয়েছে।
আরও অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, নিজেরা ব্যাংক পরিচালক হয়েও বেআইনিভাবে ইউসিবিএল ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২শ’ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করে চারজন পরিচালক বোর্ড সভার অনুমতি ছাড়া ওই ব্যাংকের গ্যারান্টি সুবিধা ভোগ করেছেন। এই চারজন হলেন ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান তমাল এসএম পারভেজ, ভাইস চেয়ারম্যান শহিদ ইসলাম পাপুল, ইসি কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমাম ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মিয়া আরজু। ওই ব্যাংক গ্যারান্টির সুবিধা নিয়েছেন রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে পাথর সরবরাহের জন্য। পাথর সরবরাহের জন্য পাপুল ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন।

News Editor : Ganash Chanro Howlader. Office: 38-42/2 Distillery Road, 1st floor, Gandaria, Dhaka-1204.