কেরানীগঞ্জ থেকে ফিরে: কুয়েত প্রবাসী স্বামীর পাঠানো কষ্টের টাকা তিল তিল করে জমিয়ে ৬ শতাংশ জমি কিনেছিলেন দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের কোণ্ডা ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের (ব্রাহ্মণগাঁও) বাসিন্দা খুকি বেগম। নিজের স্বপ্নের আদলে সাজিয়েছিলেন ছোট্ট ঘর।

অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া এক ছেলে এবং চতুর্থ শ্রেণী পড়ুয়া এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন বছরের শুরুতেই টিনের বাড়ির পরিবর্তে একটি ইটের বাড়ি তৈরির। তবে স্থানীয় ‘মাটিখেকো’ চক্র তার সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।

নিজের স্বপ্ন ভঙ্গের কথা বাংলানিউজকে বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে খুকি বেগম বলেন, ‘কখনও খেয়ে কখনও না খেয়ে টাকা জমাইয়া জায়গাটা কিনছিলাম। অহনো অনেক টাকা ঋণ আছে। না খাইয়া সেই ঋণের টাকা পরিশোধ করতাছি, আশা ছিলো নতুন বছরে ইটের বাড়ির কাজ ধরতে পারবো।’

‘কিন্তু বাড়ি আর করা হইলো না, হেরা আমার স্বপ্ন ভাইঙ্গা দিছে। ঘরের সেই জমির সব মাটি কাইট্টা লইয়া গেল। এখন অনেক খাদ, জমির কোনো চিহ্ন নাই। অগো অনেক অনুরোধ করেছি কিন্তু সুজনে আমার কথা হুনে নাই। ভেকু মেশিন (এক্সকাভেটর) দিয়ে আমার বাড়ি ভেঙে জমির মাটি কাইট্টা লয়ে গেছে। এহন আমার বাড়িতো নেই, জমিও নেই। অন্যের বাড়ি ভাড়া নিয়া থাকছি কয় মাস ধরে। আমার সব শ্যাষ কইরা দিছে সুজনে।’

খুকির মতো পাশের গ্রাম কাজীরগাঁও এলাকার বাসিন্দা রজ্জব আলীরও একই অবস্থা। রজ্জব আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের জমিতে ভেকু মেশিন দিয়ে জোর করে মাটি কাটে সুজন। আমরা কয়েকজন মিলে ভেকু মেশিনের চাবি নিয়ে নিলে তখন কাজ বন্ধ রাখে কয়েকদিন। পরে ওরা রাতের বেলায় মাটি তুলে নিয়ে যায় ওই জমি থেকে। এখন ওই জমিতে পুকুরের চেয়ে বেশি খাদ তৈরি হয়েছে। প্রতিবাদ করতে গেলে সুজনের লোকেরা পিস্তল দিয়ে গুলি করে। মেরে ফেলার হুমকি দেয়।’

পড়ুন>> নৌডাকাতের হাতে জিম্মি ‘কেরানীগঞ্জের ৫০ হাজার মানুষ’
 
একই অবস্থা গ্রামটির হালিম দোকানদার, দেলোয়ার, আয়ুব আলী, আফসারসহ পাঁচ/ছয়টি গ্রামের ৫০ হাজার বাসিন্দার। এ বিষয়ে হালিম বলেন, ‘দিন ও রাতের বেলায় সুজন, ডন ও পলাশের লোকজন আমার বাড়ির জমিটি শেষ করে দিয়েছে। এখন আর বাড়ি করার উপায় নাই। পুলিশকে জানালে উল্টো পুলিশ মামলার হুমকি দেয়। কেউ বাধা দিতে গেলে মারধরসহ নানা জুলুমের মুখে পড়তে হয়। ওদের জুলুমের ভুক্তভোগী আমি নিজেও।’

স্থানীয় মেম্বার (ইউপি সদস্য) হারুন উর রশিদ রাসেল বাংলানিউজকে বলেন, ‘সুজন, ডন ও পলাশের বাহিনী জমি দখল করে অবৈধভবাবে মাটি উত্তোলন করছে ২ বছর ধরে। আমরা গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে বেশ কয়েকবার প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি। তাদের সঙ্গে পুলিশের পাশাপাশি একাধিক সন্ত্রাসী থাকে। দিনের বেলায় প্রতিবাদ করলে রাতে তারা এসে হত্যার হুমকি দেয়, ফাঁকা গুলি করে ভয় দেখায়। ৫/৬টি গ্রাম রক্ষায় আমরা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করি।’

কে এই সুজন মিয়া: আজ থেকে ১০/১২ বছর আগে সুজন মিয়া বুড়িগঙ্গা নদীতে মাঝির কাজ করে সংসার চালাতেন। পরে মাঝি থেকে হয়ে যান নৌডাকাত, গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী সংগঠন। নিজ কব্জায় নিয়ে নেন ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

সংগঠনের নাম ভাঙ্গিয়ে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পদ দখলে নেন। শুরু করেন ফসলি জমির মাটি ও বালু উত্তোলন। এগুলো বিক্রি করতে থাকেন বিভিন্ন ইটভাটাসহ বিভিন্ন জায়গায়। জবরদখল করে অন্যের জমির মাটি উত্তোলন করে গভীর খাদ সৃষ্টি করেন। এতে বসত-বাড়ি ও সরকারি রাস্তায় হুমকির মুখে পড়ে।

এ বিষয়ে সুজনের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। উল্টো মিডিয়ার কথা শুনে তার বাহিনীর সদস্যরা বাংলানিউজসহ প্রায় আটজন সাংবাদিকের ওপর চড়াও হন। ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন ক্যামেরা, মোবাইলসহ বিভিন্ন জিনিস।

এ বিষয়ে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এলাকাটিতে দু’পক্ষের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিলো। সেটি আমরা বন্ধ করেছি। এখন কোন্ডা ইউনিয়ন থেকে কোনো ধরনের মাটি উত্তোলন হচ্ছে না।’

তবে সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে এই প্রতিবেদক ২০টিরও অধিক ট্রাকে মাটি পরিবহন ও উত্তোলনের চিত্র দেখেছেন যার তথ্য প্রমাণ সংরক্ষিত আছে। এই বিষয়ে ওসি বলেন, ‘আমার এ বিষয়ে কিছু জানা নেই। 

সহযোগিতার পরিবর্তে হয়রানি করা হয়, এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর। 

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রমিক নেতা সুজনকে আমি মদদ দেই না। তাদের বিরুদ্ধে আমি মামলা গ্রহণ করেছি।’ সে মামলার অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য না করে ফোন রেখে দেন।

তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে, অন্যায়কারী যেই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে। 

এ বিষয়ে কেরাণীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার অমিত দেব নাথ বলেন, ‘আমরা ফসলি জমি বা বিভিন্ন জমিতে মাটি উত্তোলনের বিষয়টি নিয়ে তৎপর আছি। আমরা যেহেতু বিষয়টি জানতে পেরেছি, অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘ভেকু (মাটি উত্তোলনের যন্ত্র) ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ, তবে সরকারি কোনো স্থাপনা বা রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যবহার করা যায়। এখন জানতে পারলাম সেখানে একটি গোষ্ঠী এটা ব্যবহার করে মাটি উত্তোলন করছে। আমি অবশ্যই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেব।’

বাংলাদেশ সময়: ০৭০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২০
ইএআর/এজে