অনলাইন ডেস্ক : কৈশোরেই বিয়ে হয়েছিল গোপালগঞ্জের বোড়াশী গ্রামের মঞ্জু বিশ্বাসের। স্বামী পরেশ চন্দ্র বিশ্বাস তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিয়ের পর থেকেই অনাহার, অবহেলা, লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধ্যে দিন কাটা শুরু। এরই মধ্যে জন্ম নেয় চার সন্তান। শত অত্যাচারের মধ্যে একমাত্র ভরসার জায়গা বৃদ্ধ শ্বশুর। বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শ্বশুর মারা যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েন মঞ্জু। এক দেবর ও চার সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হন স্বামীর কর্মস্থল ঢাকায়। তখন সামান্য বেতনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন স্বামী পরেশ। শুরু হয় মঞ্জুর আরেক ধরণের সংগ্রাম। কাগজের ঠোঙ্গা বানিয়ে দোকানে বিক্রি করতে শুরু করেন তিনি। অভাব-অনটনের মধ্যেই চলে সংসার। শত কষ্টের মধ্যেও কিন্তু সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এখন তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এখন তাই একটু অবসর মিলেছে। নিজের সময় আর ভালোবাসা বিলাচ্ছেন তাই অভাবী, ছিন্নমূল মানুষের প্রতি।
আরেক সংগ্রামী মা রহিমা ইসলাম ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত। স্বামী অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম শিক্ষকতা আর রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তিনি চরফ্যাশন থেকে তিনবার এমপি নির্বাচিত হন। চার ছেলেমেয়ের পরিবারের প্রথম শিক্ষক ছিলেন রহিমা ইসলাম। তার সন্তানরা সবাই উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। তার এক সন্তান পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। আরেক সন্তান কানাডা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত। অন্য সন্তানরাও সুপ্রতিষ্ঠিত।
সন্তানকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ার নেপথ্য কারিগর, হার-না-মানা এ ধরনের ৫০ সংগ্রামী মাকে তাদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেওয়া হলো ‘আজাদ প্রোডাক্টস অ্যাওয়ার্ড :রত্নগর্ভা মা-২০১৭’। রোববার বিশ্ব মা দিবসে এক জমকালো অনুষ্ঠানে মায়েদের হাতে এ সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়।
ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী সেন্টারে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি খায়রুল কবির মামুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, মোহাম্মাদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক, প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এম এস ইমরুল কায়েস, চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন আজাদ প্রোডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ।
অনুষ্ঠানে গবেষক মুস্তাফা জামান আব্বাসীর হাতে ‘মাই ড্যাড ওয়ান্ডারফুল’ সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘আমরা তাকেই খুব বেশি ভালোবাসি, যাকে আমরা ভালো জানি। মায়ের ক্ষেত্রেও তাই। মা একটি আশ্চর্য ব্যাপার। মানবজাতির ধারাবাহিকতা মায়ের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত। তিনি শুধু মানবজাতিকে ধারণ করেন না, তাকে পালন করেন, বিকশিত করে তোলেন।’
আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব বলেন, মা আমাদের সবার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। তাই শুধু আজকের দিনটি নয়, জীবনে প্রতিটি দিনই মা দিবস হওয়া উচিত।
সম্মাননার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি শৈশবে মাকে হারিয়েছি। এসব রত্নগর্ভা মায়ের মধ্যে নিজের মাকে দেখতে পাই আমি।’
‘আজাদ প্রোডাক্টস অ্যাওয়ার্ড-২০১৭’-তে সেরা রত্নগর্ভা মায়েদের দুটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। সাধারণ ক্যাটাগরিতে ২৫ ও বিশেষ ক্যাটাগরিতে ২৫ জনকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
সাধারণ ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত মা হচ্ছেন- ফিরোজা সুলতানা রশীদ, আনোয়ারা বেগম, সুরাইয়া বেগম, মাহবুবা ইসলাম, জাহানারা বেগম, শিরিন সুলতানা, কামরুজ্জাহান রেখা, নিলুফার বেগম, রহিমা ইসলাম, সামছুন্নাহার খানম, শিরিন চৌধুরী, নফছুন নাহার হাবিবা, হাজি চেমন আরা বেগম, নূরজাহান বেগম, সখিনা খাতুন, মঞ্জু বিশ্বাস, রহিমা খাতুন চৌধুরী, মমতাজ বেগম, আমেনা আফতাব, দিলওয়ারা বেগম, লায়লা বেগম, সাহিনা কবির নার্গিস, নিলুফার সুলতানা, হোসনে আরা রহমান ও ড. নীলুফার মতিন।
বিশেষ ক্যাটাগরিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত মায়েরা হলেন- সারোয়ার জাহান লুৎফে আরা রশীদ, লুৎফুন নাহার বেগম, ফেরদৌসী ইসলাম, সাইদা মঞ্জুর, সেলিনা মোহসীন, হাজি শাকুরা বেগম, শামসুন নাহার বেগম, রোমানা খাতুন, হালিমা হোসাইন, সৈয়দা মাহমুদা খাতুন, গুলশান আরা বেগম, আতফা বেগম, প্রফেসর দেলোয়ারা বেগম, মাহফুজা রহমান খান, প্রতিভা বড়ূয়া, কল্পনা বড়ূয়া, খোরশেদা খানম, হুসনে জাহান, সৈয়দা বিলকিস বানু, হেমলতা দাশ, দিলরুবা আহমেদ, প্রফেসর হাজেরা নজরুল, আখতার আরা বেগম, খানম শামসি আহমদ ও শামসুন নাহার বেগম পারুল।