দর্পণ ডেস্ক : ভাইয়ের ছেলেকে কাঁধে করে পাঁচদিন গভীর সমুদ্রে বেঁচে রইলেন রবীন্দ্রনাথ। খাবার নেই একফোঁটা, এমনকি পানিতে ভেসে থাকতে হলে আবশ্যিক যে লাইফ জ্যাকেট, তা-ও নেই! বাঁশের খুঁটি ধরে উত্তাল বঙ্গোপসাগরে পাঁচদিন ধরে ভেসে থাকার এ এক রূপকথা!

গল্পটা আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লেখেননি, গল্পটা ঠিক ওল্ড ম্যানেরও নয়। তবু গল্প সমুদ্র যাপনের। গল্প চরম প্রতিকূলতায় টিকে থাকার, গল্প বেঁচে ফেরার।

গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার উলটে নিখোঁজ জেলেদেরই একজনের গল্প এটা। কাকদ্বীপের জেলে রবীন্দ্রনাথ দাশকে শেষমেশ সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে চট্টগ্রামের উপকূলের একটি বাংলাদেশি জাহাজ। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আনা হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। গত ৬ জুলাই মাঝ সমুদ্রে তুমুল ঝড়ের সময় ডুবে যায় তার ট্রলার, একে একে মারা যায় অন্য সঙ্গীরাও। কেবল বৃষ্টির জল খেয়ে টানা পাঁচদিন সমুদ্রেই ভেসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এমভি জাওয়াদের সদস্যদের চোখে পড়ায় তাকে অবশেষে জীবন্ত উদ্ধার করা হয়।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কাকদ্বীপের নারায়ণপুর থেকে ট্রলারে রওনা হন রবীন্দ্রনাথ দাশ। এফবি নয়ন-১ এর মাস্টার ছিলেন তিনি। ৪ জুলাই ১৪ জন জেলেসহ গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য যাত্রা শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

মাঝসমুদ্রে ট্রলারটি ভেঙে ডুবতে শুরু করলে ওর মধ্যেই আটকা পড়েন তিনজন জেলে। রবীন্দ্রনাথ এবং অন্য ১১ জন সমুদ্রেই লাফিয়ে পড়েন। সমুদ্রের মধ্যে জ্বালানি নিয়ে আসা ড্রামগুলোকে খালি করে বাঁশ এবং দড়ি দিয়ে একসাথে বেঁধে ভেসে থাকেন তারা। যদিও এই খড়কুটো বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি সবাইকে। দিন কয়েক যেতে না যেতেই একে একে তার ১১ জন সহকর্মীই পানিতে ডুবে যান। অবিশ্বাস্যভাবে তখনও ভেসে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। উত্তাল সমুদ্রে, একা অভুক্ত দিনরাত ভেসে থাকেন তিনি।

অবশেষে, ১০ জুলাই চট্টগ্রামের কাছে একটি বাংলাদেশি ভেসেলের চোখ পড়ে তার ওপর। দুই ঘণ্টার টানা চেষ্টার পর শেষমেশ উদ্ধার করা হয় রবীন্দ্রনাথকে। কলকাতায় পৌঁছনোর একদিন পরে তিনি তার এই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জানান, ‘যতটুকু আমার যা মনে পড়ছে, আমার ট্রলারটি ডুবে যেতে শুরু করে এবং আমরা জলে লাফিয়ে পড়ি। জলেই ভেসেছিলাম আমি। এই এতটা সময় আমি কিচ্ছুটি খাইনি। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল এবং বিশাল বড় বড় ঢেউ ছিল সমুদ্রে। একমাত্র বৃষ্টি হলে সেই জল খেতাম।’

অবিশ্বাস্যভাবে তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু নিজের বেঁচে ফেরার আনন্দ ম্লান হয়ে গিয়েছে ওই পানিতে ভেসে থাকা অবস্থায় একটি ঘটনাতেই। রবীন্দ্রনাথকে যখন উদ্ধার করা হয়, তার কয়েক ঘণ্টা আগেই ভেসে থাকতে থাকতে একসময় ডুবে যায় তার ভাইপো। ভাইপোর এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই শোকাচ্ছন্ন তিনি।

সেই দিনের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমরা একসঙ্গেই ভাসছিলাম, ওর লাইফ জ্যাকেটও ছিল। কিন্তু ও প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। তাই দিন কয়েক ধরে আমিই ওকে জলের মধ্যেই কাঁধে নিয়ে ভেসেছিলাম। কিন্তু আমাকে যখন ওই জাহাজটা উদ্ধার করে বাঁচিয়ে নেয়, তার ঘণ্টাখানেক আগেই ভাইপো ডুবে যায়।’