গোফরান পলাশ, পটুয়াখালী: নৌকায় জন্ম, নৌকায় বেড়ে ওঠা, নৌকায় বসবাস,
নৌকাতেই মৃত্যু। নেই নির্দিষ্ট বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সহ মৌলিক
অধিকার। নৌকায় করে নদীতে মাছ ধরে চলে তাদের জীবন-জিবীকা। সারাদিনের
রোজগারে সন্ধ্যায় নৌকার ছাউনিতে তাদের চুলা জ্বলে। মানতা সম্প্রদায়
হিসেবে পরিচতি এ জনগোষ্ঠীর মানুষের প্রায়শ:ই দেখা মেলে পটুয়াখালীর
কলাপাড়া, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, বাউফল, মহিপুর এলাকার অন্তর্গত নদ-নদীসহ
সাগর মোহনায়। ঠিকানা বিহীন গন্তব্যে তাদের প্রতিনিয়ত ভেসে চলা। সমুদ্রের
নোনা জল আর ঢেউয়ের সাথে মিশে যায় তাদের ছোট-ছোট স্বপ্ন। একটুকরো জমির
মালিকানা না থাকায় নদীতে বসবাসকারী এ সম্প্রদায়কে প্রতিনিয়িত প্রাকৃতিক
দূর্যোগ আর নানা প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। যেসব নদীর
পানিতে জোয়ার-ভাটার টান খুব ধীর, তাদের নৌকার বহর নোঙ্গর করে সেখানেই।
দিনের বেলা নদীর তীরে থাকলেও চোর-ডাকাতের ভয়ে রাতে মাঝ নদীতেই অবস্থান
নেয় তারা। মাছ পেলে তা বিক্রি করে জোটে খাবার। না পেলে থাকতে হয় উপোষ।
নৌকার ছাউনিতেই জন্ম হয় শিশুদের। পানিতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে কোমড়ে দড়ি বেঁধে
বেড়া ওঠা। নৌকাতেই মৌলিক অধিকার বঞ্চিত থেকে একটু বাড়ন্ত হলেই বাবা-মার
সাথে নেমে যেতে হয় জীবন যুদ্ধে। এদের কিছু সদস্যের রয়েছে জাতীয়
পরিচয়পত্র, অধিকাংশেরই নেই। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী এ জনগোষ্ঠীর
কপালে খুবই কম জোটে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা।

মানতা সম্প্রদায় সূত্রে জানা যায়, নদী বা সাগর মোহনায় বসবাস করায়
দক্ষিণাঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুপার সাইক্লোন সিডরের তান্ডবে এদের
অর্ধশতাধিক নৌকা ডুবে যায়। সে সময় জীবন বাঁচাতে পারলেও মাছ ধরার জাল এবং
বড়শি হারিয়ে অনেকে নি:স্ব হয়ে পড়ে। সিডর পরবর্তী সময়ে সরকারি এবং
বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সহায়তা, ঘর নির্মাণসহ নানা সুবিধা
প্রদান করা হলেও এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত এরা। এদের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা
তো দূরের কথা, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন কিংবা বিশুদ্ধ খাবার পানির কোন
ব্যবস্থা নেই । শিক্ষা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সহ সমাজ-সভ্যতার কৃষ্টি
সংস্কুতির কোন ছোঁয়া লাগে না এদের গায়ে। রোগ-বালাই সারতে দৌড়ে যায়
স্থানীয় কবিরাজ, বৈদ্যের কাছে।

তিন সন্তানের জননী রোকেয়া বেগম (৩৫) জানান, একসময় জেলার বাউফলে উপজেলার
কালাইয়ার আদিবাসী ছিলেন। নদী ভাঙনে নি:স্ব হয়ে শত বছর আগে তার পূর্ব
পুরুষরা চরমোন্তাজ ইউনিয়নের বুড়াগৌরঙ্গ নদীর কিনারে ঘাঁটি গাড়েন। তখন
থেকেই এ নদী তীরেই তাদের বসবাস। বাবা সালাম সরদার ও মা রাহিমা অনেক আগেই
মারা গেছেন। স্বামী আলতাফ সরদারকে ছেলে শাকিব, আখিদুল ও নাজিম মাছ ধরতে
সহায়তা করে। এ থেকেই জীবিকা নির্বাহ হয় তাদের।

ছয় সন্তান নিয়ে ছোট্ট একটি নৌকার ছাউনিতে বসবাসরত পারুজান বিবি জানান,
অন্যদের মত জাল না থাকায় বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন। তাই আয়-রোজগার কম। ফলে
সংসার চলে টেনেটুনে। প্রায় শত বছর ধরে নদী এবং সাগর মোহনায় বসবাসকারী এ
জনগোষ্ঠীর অনেকেই এখন ফিরতে চান স্বাভাবিক জীবনের মুল স্রোতে। তবে এ
পুন:র্বাসনে তারা চান সরকারী সহায়তা।