দিবাকর সরকার, কলাপাড়া (পটুয়াখালী): পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানধাখালীতে আন্ধারমানিক ও রাবনাবাদ নদীর সঙ্গম স্থলে গড়ে উঠছে ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।
সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের আগস্টে উৎপাদনে আসছে ৬৬০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিট। এ লক্ষ্যে ২৪ ঘণ্টা বিরামহীন কাজ চলছে।পায়রা বন্দরের নামানুসারে এর নামকরণ হয়েছে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের। প্রায় ১ হাজার একর জায়গায় গড়ে উঠছে কেন্দ্রটি পরিবেশের ভারসাম্যের প্রতি নজর দিয়ে আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে তৈরি হচ্ছে এই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। যার যৌথ মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিলিমিটেড ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)। উভয়ের ৫০ভাগ করে মালিকানা রয়েছে এ কেন্দ্রে। মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশ বহন করছে (বিসিপিসিএল)। বাকি ৭০শতাংশ চীনের এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সম্পন্ন করতে সব মিলিয়ে ব্যয় হবে ২.৪৮ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।
পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চলতি বছরের এপ্রিল মাসে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও কারিগরি জটিলতায় তা আগস্ট মাসে গড়াবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দ্বিতীয় ইউনিট থেকেআরও ৬৬০ মেগাওয়াট উৎপাদনে আসবে প্রথম ইউনিটের ছয় মাস পর। তাই প্রথম ইউনিটের পাশাপাশি দ্বিতীয় ইউনিটের কাজও এগিয়ে চলছে। দুটি প্ল্যান্ট উৎপাদনে আসলে এটিই হবে দেশের সর্ববৃহৎবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র। এখন পর্যন্ত দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। সেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৯৫০ মেগাওয়াট।
গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি ৬০ ভাগ। প্রশাসনিক ভবন, ডরমেটরি, পুলিশ ফাড়ি, হেলিপ্যাডসহ অধিকাংশ স্থাপনার কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। টারবাইন, ট্রান্সফরমার, জেনারেটরসহ প্রধান যন্ত্রপাতিও প্রকল্প এলাকায় পৌঁছে গেছে। চলছে স্থাপনের কাজ। ২২০ মিটার দীর্ঘ চিমনির ৫০ মিটার সম্পন্ন হয়েছে। ৩৮৫ মিটার দীর্ঘ স্থায়ী জেটির কাজ শেষ হবে চলতিমাসে। এ জেটিতে একত্রে চারটি লাইটারেজ জাহাজ কয়লা আনলোড করতে পারবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। প্রকল্পের কাজ দ্রুতগামী করতে দেশ-বিদেশের প্রায় ৭ হাজার কর্মী কাজ করছে। যার মধ্যে চীনা কর্মীআছে ২ হাজার।
পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেন্দ্রটিতে দিনে ১৩ হাজার টন কয়লা পোড়াতে হবে। বার্ষিক চাহিদা দাঁড়াবে ৪২ লাখ থেকে ৪৬ লাখ টন। সার্বক্ষণিক মজুদ থাকবে ৪০ দিনের কয়লা। প্রাথমিকভাবেইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের। আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমও শেষ পর্যায়ে। সবকিছু ঠিক থাকলে বছরের মাঝামাঝি সময় কয়লা আমদানী শুরুহতে যাচ্ছে। দেশ-রূপান্তরকে এসব তথ্য জানান বিসিপিসিএল’র সহকারি প্রকৌশলী রিফাত আল আহমেদ। তিনি আরও জানান, নাব্যতা সংকট থাকায় শুরুতে ৭০ হাজার টন ধারণক্ষমতার মাদার ভ্যাসেলবহির্নোঙ্গরে রেখে লাইটারেজ জাহাজে করে কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করা হবে। একেকটি লাইটারেজ জাহাজ ১০ হাজার টন কয়লা বহনে সক্ষম। এর চলাচলের জন্য দরকার ৮ মিটার ড্রাফট। রাবনাবাদচ্যানেলে সর্বনিন্ম গভীরতা আছে ৫ মিটার। এখন বিসিপিসিএল’র তত্ত্বাবধানে নদীর গভীরতা ৮ মিটার ড্রাফটে উন্নীত করা হচ্ছে। খননের কাজটি করছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন,পায়রা বন্দরকর্তৃপক্ষ বৃহৎ পরিসরে খনন কাজ সম্পন্ন করলে কেন্দ্রের জেটিতেই মাদার ভ্যাসেল ভিড়তে পারবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পায়রায় কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ নিয়ে আসা হবে গোপালগঞ্জে নির্মানাধীন সাব-স্টেশনে। এখান থেকেইবিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে। ১৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইনের প্রতি ফেজ-এ চারটি করে অত্যাধুনিক ‘এসিসিসি কন্ডাক্টর’ (তার) ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে অন্যান্য ৪০০কেভি লাইনের তুলনায় এই লাইনের সঞ্চালন সক্ষমতা কয়েকগুণ বেশি হবে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)’র তত্ত্বাবধানে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান জিএস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনকরপোরেশন এ কাজ সম্পন্ন করবে।
এর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, আগস্টের মধ্যে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উৎপাদনে এলেও যথা সময়ে সঞ্চালনলাইন সম্পন্ন হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনের পরও কেন্দ্রটির বসে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। বিলম্ব হলে বিসিপিসিএল’র সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণগুনতে হতে পারে বিদ্যুৎ বিভাগকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পরবর্তীতে আরও একটি কয়লা ভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট প্ল্যান্ট নির্মিত হবে।যার কাজ চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হতে পারে। জার্মানির সিমেন্সএজির সঙ্গে সম অংশিদারিত্বে ভিত্তিতে এলএনজি ভিত্তিক ৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উপাদন কেন্দ্রের কাজও শীঘ্রই শুরু হচ্ছে। বিসিপিসিএল’র অভ্যন্তরেই তাদের জন্য ১০০ একর জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।যেখানে এখন বালি ভরাটের কাজ চলছে। এছাড়া পরিকল্পনায় ১০০ মেগাওয়াট সৌর ও ৫০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের কথা থাকলে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিকল্পনা থেকে বাতিল করা হয়েছে।বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। এছাড়া এই কেন্দ্রর পাশেই রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ১৩২০ মেগাওয়াট এবং আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন লিমিটেড ১৩২০ মেগাওয়াটক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে।