হাজার হাজার মানুষ এসেছিলেন প্রিয় আমজাদ হোসেনের জন্য। এসেছিলেন বিশিষ্টজন, সহকর্মী, বন্ধু আর শুভানুধ্যায়ীরা। সবার চোখে ছিল অশ্র“ আর মনে বিষাদ। তবুও অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা সিক্ত করে কিংবদন্তি আমজাদ হোসেনকে বিদায় জানালেন।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা শেষে প্রিয় কর্মস্থল এফডিসি, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আইতে নেয়া হয় আমজাদ হোসেনের মরদেহ। কয়েক দফা জানাজা শেষে বিকালে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় জামালপুরে। পারিবারিক কবরস্থানে সেখানে আজ রোববার সকালে বাবা-মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন গুণী এই চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা ও কথাশিল্পী।

শহীদ মিনারে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা : বারডেমের হিমঘর থেকে সকাল ১১টা ২০ মিনিটে আমজাদ হোসেনের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে সেখানে অনুষ্ঠিত হয় নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব। এ শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বে নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী, শিক্ষাবিদসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানায়।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে শ্রদ্ধা জানান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, মসিহউদ্দিন শাকের, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মোরশেদুল ইসলাম, ম. হামিদ, নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান, গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর, নাট্যজন কেরামত মাওলা থেকে শুরু করে অভিনয়শিল্পী রোকেয়া প্রাচী, চিত্রনায়ক হেলাল খান, আজাদ আবুল কালাম, সালাউদ্দিন লাভলু, এসএ হক অলিকসহ অনেকেই।

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে- সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, দেশ নাটক, প্রাচ্যনাটক, অভিনয় শিল্পী সংঘ, ডিরেক্টরস গিল্ড, টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল (জাসাস), বাংলাদেশ শুটিং হাউস অ্যাসোসিয়েশন, যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ, গণসংগীত শিল্পী সমন্বয় পরিষদ। এছাড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়।

এ সময় মরদেহের পেছনে অশ্রুসিক্ত নয়নে দাঁড়িয়েছিলেন দুই ছেলে সোহেল আরমান ও সাজ্জাদ হোসেন দোদুলসহ পরিবারের সদস্যরা। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বড় ছেলে সাজ্জাদ হোসেন দোদুল বলেন, আমার বাবা ছিলেন নির্লোভ একজন মানুষ। তিনি দেশকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন। সেই ‘জীবন থেকে নেয়া’ থেকে শুরু করে ‘কাল সকালে’ পর্যন্ত তার কলম চলেছে সমান্তরালে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সিনেমা আমার বাবা নির্মাণ করেন। সিনেমার নাম ছিল ‘বাংলার মুখ’, আমরা সেই সিনেমার পোস্টার দেখেছি। একাত্তরের যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এই ছবিটির দৃশ্য ধারণ করা হয়।
কিন্তু এফডিসি থেকে কোনো কালো হাত সেই ছবির পিকচার ও সাউন্ড নেগেটিভ গায়েব করে দেয়। যদি ‘বাংলার মুখ’ আলোর মুখ দেখত তাহলে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে উচ্চারিত হতো আমার বাবার ছবির নাম। ছোট ছেলে সোহেল আরমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমাদের পুরো পরিবার কৃতজ্ঞ। বাবা অসুস্থ হলে শুরুতে প্রধানমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে তার চিকিৎসার ব্যয়ভার গ্রহণ করেছেন।

সহায়তা দিয়ে ব্যাংককে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। আর একজন শিল্পী যে সম্মান নিয়ে পৃথিবী থেকে যেতে চান, আমার বাবাকে সেই সম্মানই দেয়া হচ্ছে। বিদায়যাত্রায়ও নিয়ে গেলেন অগণিত মানুষের ভালোবাসা।

একজন শিল্পীর চলে যাওয়ার সময় এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর হতে পারে না।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভায় উজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব। চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে গান রচনা, নাটক লেখা কিংবা সাহিত্য সৃজন- সবকিছুতেই ছিলেন অনন্য। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি যেভাবে এদেশকে তুলে এনেছেন, তা আর কেউ পারেননি। গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষটি সেলুলয়েডে সেই জীবনটাকে সুন্দর করে তুলে ধরেছেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, তিনি এদেশের সুস্থ চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। মামুনুর রশীদ বলেন, তিনি বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, তিনি এ দেশের চলচ্চিত্রে নতুন আবহাওয়া সৃষ্টি করেছিলেন।

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি তার লেখনী দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, তার মৃত্যুতে চলচ্চিত্রের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তির ধারক ও বাহক। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের শ্রদ্ধা জানানোর পর এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শেষ শ্রদ্ধানুষ্ঠান।

এফডিসিতে আমজাদ হোসেন : নিজের প্রিয় প্রাঙ্গণ ও দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনে (বিএফডিসি) সুহৃদ, সহকর্মী ও শিল্পীদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও এটিএন বাংলার কার্যালয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে মরদেহ যখন এফডিসিতে আনা হয় তখন এক শোকের আবহে ঢেকে যায় সমগ্র এফডিসি। সেখানকার মান্না ডিজিটাল সাউন্ড কমপ্লেক্সের সামনে স্থাপিত শোকের রঙ কালো রঙের কাপড়ে আবৃত মঞ্চে মরদেহটি রাখার সঙ্গে সঙ্গে আবেগাপ্লুুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রিয় সহকর্মী ও শিল্পীরা।

এ সময় তার মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তথ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্যমন্ত্রীর পক্ষে প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, চলচ্চিত্রকার গাজী মাযহারুল আনোয়ার, অভিনেত্রী আনোয়ারা, নায়ক আলমগীর, প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু, চিত্রনায়ক ওমর সানী, আরেফিন শুভ, ড্যানি সিডাক, হেলাল খান। প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিকভাবে ফুলেল শ্রদ্ধা জানায় বিএফডিসির পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমির হোসেন, ডিরেক্টরস গিল্ডের পক্ষে সালাহউদ্দিন লাভলু ও এসএ হক অলিক, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির পক্ষে রিয়াজ, ফেরদৌস, জায়েদ খান, সায়মন সাদিক, বাচসাসের পক্ষে সভাপতি আবদুর রহমান, এডিটরস গিল্ডের পক্ষে আবু মুসা দেবু, সিনে স্টার ফোরামের পক্ষে শফি বিক্রমপুরী, প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালকদের সংগঠন সিডাব, চলচ্চিত্র ব্যবস্থাপক সমিতি, চিত্রগ্রাহক সংস্থা, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র নৃত্য পরিচালক সমিতি, অঙ্গসজ্জাকর সমিতি, বাংলাদেশ ফিল্ম ক্লাব, মানিকগঞ্জ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

তথ্যমন্ত্রীর পক্ষে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, আমজাদ হোসেনের মৃত্যুতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র একজন শিক্ষক, একজন মনীষী, একজন গুণী ও সর্বোপরি একজন ভালো মানুষকে হারালো। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রেখেছিলেন।

শ্রদ্ধা জানাতে এসে ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’র চলচ্চিত্রের নায়িকা ববিতা বলেন, বাংলা চলচ্চিত্রের মাইলফলক হয়ে থাকবেন আমজাদ হোসেন। চলচ্চিত্রে এ গুণী মানুষটির অবদানের কথা বলে শেষ করা যায় না। তার প্রতিটি চলচ্চিত্র সমাজের কথা বলেছে। ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে বিভিন্ন উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম।

চিত্রনায়ক ফারুক বলেন, সৃষ্টির মধ্য দিয়েই মনে রাখতে হবে তাকে। ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’ দেখে মনে হয়েছিল, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের মধ্যে তিনি একজন। আলমগীর বলেন, সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন এফডিসির ডিরেক্টরস স্টাডি রুমে তার সঙ্গে আড্ডা হতো। সেসব আড্ডা ছিল এক একটি ক্লাস, যার শিক্ষক ছিলেন আমজাদ হোসেন। এরপর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে চ্যানেল আইতে নিয়ে যাওয়া হয় মরদেহ।

চ্যানেল আই : এফডিসিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে আমজাদ হোসেনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় চ্যানেল আইয়ে। এ পর্বে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজ, অভিনেতা ও নাট্যকার মামুনুর রশিদ, অভিনেতা আফজাল হোসেন, চ্যানেল আইর পরিচালক (বিক্রয় ও বিপণন) ইবনে হাসান খান। শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে সেখানে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় নামাজে জানাজা। এর আগে আমজাদ হোসেনের সঙ্গে চ্যানেল আইয়ের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন চ্যানেল আইয়ের বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজ।