মিজানুর রহমান, ঠাকুরগাঁও সংবাদদাতাঃ শুক নদীর পারঘেঁষা ছোট সাঁওতালপল্লীতে সারি সারি মাটির ঘর। কোনোটির ছাউনি টিনের, কোনোটির খড়ের। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে নারগুণ ইউনিয়নের শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামে এই সাঁওতালপল্লী। নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরছিলেন সত্তরোর্ধ্ব বেটকা বেসরা।
নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের পল্লীর সবাই রমেশ বাবুর ভক্ত। সাঁওতালদের জন্য বাবু অনেক কাম করেছেন। আমরা তাই নৌকায়ই ভোট দেব।’
শুক নদীর তীর থেকে কিছু দূরে নারগুণ ইউনিয়নের কহরপাড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাজার ছেয়ে আছে পোস্টারে। নৌকা আর ধানের শীষের প্রায় সমান প্রচার। চায়ের স্টলে বসা সোলায়মান হোসেন বলেন, ‘ফখরুল স্যার আমাদের নিয়মিত খোঁজখবর নেন। তাঁর পক্ষেই আমরা মাঠে থাকব। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে ধানের শীষই জয়ী হবে।’ সোলায়মানের কথায় সায় দেন রতন মিয়া ও জাহাঙ্গীর হোসেন।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-১ আসনে বড় দুই দলের দুই প্রার্থীই প্রভাবশালী। ১০ বছর পর এ আসনে ভোটযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন পুরনো দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন এমপি এবং বিএনপির মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শীর্ষস্থানীয় দুই নেতার ভোটযুদ্ধকে ‘মর্যাদার লড়াই’ হিসেবে দেখছে অনেকেই।
সদর উপজেলার পৌরসভা ও ২১টি ইউনিয়ন নিয়ে ঠাকুরগাঁও-১ আসন। মোট ভোটার চার লাখ ২১ হাজার ৬২২ জন। নৌকার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত উত্তরবঙ্গের এ আসনটিতে পিছিয়ে নেই বিএনপিও। দুই দলেরই সাংগঠনিক ভিত্তি দৃঢ়। দশম সংসদ নির্বাচনের আগের কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে এ আসনে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়েছে রমেশ ও ফখরুলের। একে-অপরের বিরুদ্ধে হার-জিতের রেকর্ড যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস। এবার সেই প্রতিযোগিতা আগের চেয়ে বেড়েছে বলেই মনে করছেন স্থানীয় অনেক ভোটার।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় মারা গিয়েছিলেন প্রিসাইডিং অফিসারসহ চারজন। এবারও নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে অনেকেই।
ঠাকুরগাঁও পৌরসভা এলাকা ঘুরে দুই প্রার্থীরই জমজমাট প্রচার চলছে দেখেন সাংবাদিক মজিবর রহমান শেখ। শহরের আনাচ-কানাচে, অলিগলিতে পোস্টার আর পোস্টার। মাইকে বাজছে দুই প্রার্থীর পক্ষে নানা গান। শহরের এখানে-ওখানে গড়ে তোলা হয়েছে নির্বাচনী ক্যাম্প। ঠাকরগাঁও পৌরসভা এলাকায় ক্ষেত্রবিশেষ নৌকার চেয়ে ধানের শীষের প্রচার বেশি লক্ষণীয়। তবে গ্রামাঞ্চলে নৌকার প্রচার বেশি।
ঠাকুরগাঁও পৌরসভা পেরিয়ে সাত কিলোমিটার দূরে আক্চা ইউনিয়নের বখশের হাট। আশপাশে রয়েছে চিলারং, আখানগর, ঢোলার হাট ইউনিয়ন। বখশের হাটে রাস্তার দুই পাশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নির্বাচনী ক্যাম্প। হাটের চায়ের স্টলগুলো নির্বাচনী আড্ডায় মুখর। একটি চায়ের দোকানে চিলারং ইউনিয়নের মহাদেবপুর গ্রামের মতিউর রহমান বলেন, ‘নৌকা ও ধানের শীষের দুজনই যোগ্য প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে জবর লড়াই হবে।’ একই আড্ডায় আকচা ইউনিয়নের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘লড়াই হলেও নৌকাই জয়ী হবে। রমেশ বাবু ১০ বছরে যত উন্নয়ন করেছেন, ঠাকুরগাঁওয়ের ইতিহাসে তা হয়নি। মানুষ বাবুকেই ভোট দেবে।’
রুহিয়া, দেবীপুর, সালন্দর, বালিয়া, জগন্নাথপুর, গড়েয়া ইউনিয়নের নানা জায়গায় ঘুরে জানা যায়, রমেশ চন্দ্র সেনের উদ্যোগে গ্রামেগঞ্জে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। সদর উপজেলার প্রায় সব গ্রামে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। উপজেলার প্রায় ৯০ শতাংশ রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়েছে। ফলে সাধারণ ভোটারদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়।
২০০১ সালের নির্বাচনে রমেশ চন্দ্র সেনকে পরাজিত করেছিলেন মির্জা ফখরুল। স্থানীয় অনেকেরই অভিযোগ রয়েছে, ফখরুল প্রতিমন্ত্রী হয়েও তখন এলাকায় তেমন উন্নয়নকাজ করেননি। এ ইস্যুতে ফখরুল খানিকটা পিছিয়ে। তবে ঠাকুরগাঁও পৌরসভা ও বিভিন্ন ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ফখরুল তেমন উন্নয়ন না করলেও নানা কারণে তাঁর জনপ্রিয়তা রয়েছে। নিয়মিত এলাকায় আসেন, কর্মীদের খোঁজখবর রাখেন। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের একসময়ের শিক্ষক ফখরুল তাঁর আন্তরিকতা ও সৌজন্যের জন্য অনেকেরই কাছে ‘আলমগীর স্যার’ নামে পরিচিত।
‘জাতীয় আদিবাসী পরিষদ’ ঠাকুরগাঁওয়ের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ইমরান হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘হিন্দুপ্রধান এলাকা ও আদিবাসী পল্লীগুলোয় একচেটিয়াভাবে ভোট পাবেন রমেশ চন্দ্র সেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির ভোটও পড়বে নৌকার বাক্সে। সংখ্যালঘুদের নিজস্ব ভোটব্যাংক ও উত্তরবঙ্গে লাঙলের ভোটের জন্যই রমেশের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।’
অনেকে বলছে, ঠাকুরগাঁও-১ আসনে জামায়াতেরও রয়েছে নিজস্ব ভোটব্যাংক। মির্জা ফখরুল জামায়াতের ভোট পেয়ে ক্ষেত্রবিশেষ এগিয়ে যেতে পারেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রমেশ ৫৬ হাজার ৬৯০ ভোটের ব্যবধানে ফখরুলকে পরাজিত করেছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে মির্জা ফখরুল ৩৭ হাজার ৯৬২ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন রমেশকে। এর আগে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খাদেমুল ইসলাম পেয়েছিলেন ৬২ হাজার ৭০৯ ভোট আর বিএনপির মির্জা ফখরুল পান ৫৮ হাজার ৩৬৯ ভোট। আলাদা নির্বাচন করে জামায়াতের রফিকুল ইসলাম পেয়েছিলেন ১৭ হাজার ২৪২ ভোট।
ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র এবং মির্জা ফখরুলের অনুজ মির্জা ফয়সল আমিন বলেন, ‘আমাদের প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেওয়া হচ্ছে ব্যাপকভাবে।বিভিন্ন জায়গায় নেতাকর্মীদের হুমকি-ধমকি দেওয়া, পোস্টার-ব্যানার ছেঁড়া, মারধর করা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার পরও আমরা নির্বাচনের মাঠ ছাড়ব না।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন যদি ২৫ শতাংশও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, ধানের শীষই জয়ী হবে।’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল নিজ আসনে ছিলেন না। একাধিকবার তাঁকে ফোন করা হলেও পাওয়া যায়নি।
ঠাকুরগাঁও সদরের কলেজপাড়ায় রমেশ চন্দ্র সেনের বাসা। গতকাল বিকেলে সেখানেই তিনি বলেন, ‘তৃতীয়বারের মতো এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছি। আশা করি, এবারও নির্বাচিত হব। আমি ঠাকুরগাঁওয়ের রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা, মন্দির-মসজিদ স্থাপনসহ অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। ঠাকুরগাঁও সদরের প্রতিটি গ্রামেই বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। এর আগে কখনোই এত উন্নয়নকাজ হয়নি।
ব্যক্তিগত জীবনে আমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। সারা জীবন মানুষের সেবা করেছি, আগামী দিনেও সেবা করে যেতে চাই।