দর্পন ডেস্ক : সারাদেশে বহু আসনে বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় হতাশা বিরাজ করছে সরকারবিরোধী এই জোটে। আপিলে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র টিকবে কিনা, তা নিয়েও রীতিমতো সংশয়ে রয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
তবে নিজ দল ও জোটের প্রার্থীদের মনোনয়ন দাখিল বিষয়ে আরও সতর্ক থাকার প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করছেন নেতাকর্মীরা।

এ ব্যাপারে কয়েকজন নেতা বলেন, দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকে প্রায় প্রত্যেক আসনেই বিকল্প প্রার্থী দিয়েছিল বিএনপির হাইকমান্ড। কিন্তু এরপরও বিভিন্ন মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়া ও ঋণখেলাপিসহ বিভিন্ন কারণে সারাদেশে বিএনপিসহ ২০ দলের ৮০ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এছাড়া ছয়টি আসনে দলের সব প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় ওইসব আসন বিএনপি প্রার্থীশূন্য হয়ে পড়েছে।

যদিও বিএনপি নেতাদের দাবি, সরকারের ইন্ধনেই নির্বাচন কমিশন বেছে বেছে বিএনপিসহ বিরোধী দলের জনপ্রিয় প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল করেছে। এসব প্রার্থী মনোনয়নপত্রের সঙ্গে যথাযথ কাগজপত্র দাখিলের পরও রিটার্নিং কর্মকর্তারা সেসব আমলে নেননি। তারা একতরফাভাবে এসব প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেছেন। তবে প্রার্থিতা বাতিলের পেছনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ‘অসচেতনতা’ ও ‘অবহেলা’কেও দায়ী করছেন অনেক নেতা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা বলেছেন, এ বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। যেমন উচ্চ আদালত থেকে আগেই নির্দেশনা ছিল, বিভিন্ন মামলায় দুই বছরের বেশি দণ্ডিত নেতারা নির্বাচনের প্রার্থী হতে পারবেন না। ঋণখেলাপিদেরও কোনো অবস্থায় প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। এরপরও দল থেকে এমন অনেককে প্রার্থী করাটা ঠিক হয়নি। এখন তাদের নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার বিষয়টি বিশেষ করে হেভিওয়েট প্রার্থীদের বাদ পড়ে যাওয়া নির্বাচনের মাঠে দলের জন্য নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যা ক্ষমতাসীন দল ও জোটকে নির্বাচনী প্রচারণায় বাড়তি সুবিধাও বয়ে আনতে সহায়ক হবে।

বিএনপির এক নেতা জানিয়েছেন, এটা সবার জানার কথা যে, দুই বছরের বেশি দণ্ডিত কেউ নির্বাচন করতে পারবেন না। আদালত সম্প্রতি এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলেছেন। কিন্তু বিএনপিসহ জোট প্রার্থীদের অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে এ কারণেই। এর মধ্যে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, সাবেক এমপি মসিউর রহমান, ঝিনাইদহের বিএনপি নেতা আবদুল ওহাব ও সাবেক এমপি ওয়াদুদ ভূঁইয়া যে নির্বাচন করতে পারবেন না, তা আদালত স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছিলেন অতি সম্প্রতি। ফলে তাদের মনোনয়ন দেয়া কোনোভাবেই উচিত হয়নি। জেনেশুনে এসব নেতাকে দলের প্রার্থী করা মোটেই ঠিক হয়নি। যদিও এসব নেতার আসনে বিকল্প প্রার্থী মনোনয়ন দেয় বিএনপি। এর মধ্যে বগুড়া-৭ খালেদা জিয়ার আসনে দলটির সব প্রার্থীর মনোনয়নই বাতিল হয়েছে।

অবশ্য বিএনপির কোনো কোনো নেতা অভিযোগ করছেন, বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের বেশিরভাগেরই মনোনয়ন বাতিল হয়েছে ঠুনকো অজুহাতে। রিটার্নিং কর্মকর্তারা বিএনপির প্রার্থীদের কোনো কথাই শুনতে চাননি। এমনকি তাদের কাগজপত্র সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়নি।

বিএনপির নেতাদের দাবি, দেশের বিভিন্ন আসনে মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত বিএনপির জনপ্রতিনিধিরা এমপি নির্বাচনের জন্য পদত্যাগ করেন। এসব পদত্যাগপত্র মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেয়া হলেও নির্বাচন কমিশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা তা আমলে নেননি। কিন্তু স্থানীয় সরকার আইনে এসব জনপ্রতিনিধি যখনই পদত্যাগপত্র জমা দেবেন তখন থেকেই তার পদত্যাগ গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়।

অথচ ‘পদত্যাগ কার্যকর হয়নি’- এ অজুহাত দেখিয়ে অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, তিনি ঋণখেলাপি। কিন্তু সংশ্নিষ্টরা দাবি করেছেন, তারা খেলাপি নন। সেই কাগজপত্রও মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেয়া হয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা আমলে নেয়নি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেছেন, নানা অজুহাতে তাদের অনেক প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। তাদের শঙ্কাও ছিল। এ কারণে তাদের একাধিক প্রার্থী দেয়া হয়েছিল। এরপরও যেসব কারণে বাতিল করে দেয়া হয়েছে, সেগুলো খুঁজে দেখবেন তারা।

অন্যদিকে ঋণ পরিশোধ করার পরও মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে এমন অভিযোগ করেছেন বিএনপির অনেক নেতা। এর মধ্যে ঢাকা-১৪ আসনের সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক সাজুর মনোনয়ন বাতিল অন্যতম। এ বিষয়ে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে আইডিএলসিতে ঋণ থাকলেও গত ২৬ নভেম্বর তা পুরো পরিশোধ করে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা আমলে নেয়নি। তিনি এর বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।

উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করার পরও মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয় ঢাকা-১ আসনের বিএনপির প্রার্থী খন্দকার আবু আশফাকের। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, তার দায়িত্ব ছিল পদত্যাগ করার। তিনি তা করেছেন। এখন এটা গৃহীত হবে কি হবে না, এটা সরকারের বিষয়। তিনি এর বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষর সন্দেহেও বেশ কয়েক প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নেতাকর্মীরা। ভিন্ন দিকে মনোনয়নপত্রে বেশ কিছু ভুলের কারণে অনেকের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপি প্রার্থী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোর্শেদ খানের বিরুদ্ধে চার হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল খেলাপির অভিযোগ রয়েছে। তার মতো বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদের এ ধরনের ভুল মেনে নিতে পারেননি দলটির নেতাকর্মীরা। একইভাবে হবিগঞ্জ-১-এ গণফোরাম মনোনীত প্রার্থী ড. রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে ক্রেডিট কার্ডের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার খেলাপির অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে রেজা কিবরিয়া বলেছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এদিকে পটুয়াখালী-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী গোলাম মাওলা রনিও ঠুনকো অভিযোগের শিকার হয়েছেন। হলফনামায় স্বাক্ষর না থাকায় তার মনোনয়ন বাতিল করা হয়। এ বিষয়ে গতকাল সংবাদমাধ্যমকে সাবেক এমপি গোলাম মাওলা রনি জানিয়েছেন, এটা একটি সাধারণ ভুল ছিল। তিনি এখন নিয়ম মেনে আপিল করেছেন মনোনয়নপত্র গ্রহণ করার জন্য। তিনি আশা করছেন, তার প্রার্থিতা টিকে যাবে।

একইভাবে নওগাঁ-৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন নওগাঁ পৌরসভা মেয়র নজমুল হক সনি। তার পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ায় মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। বগুড়া-৭ খালেদা জিয়ার আসনে আরও তিনজনকে মনোনয়ন দিয়েছিল বিএনপি। তাদের সবার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরকার বাদল এবং গাবতলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোর্শেদ মিল্টন। মোর্শেদ মিল্টন বলেছেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগেই তিনি চেয়ারম্যান পদ ছেড়েছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্রও দিয়েছেন। পদত্যাগপত্র গ্রহণের চিঠি দেখানোর পরও তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। তিনি আপিল করবেন।

বিএনপি মহাসচিবের স্বাক্ষর সন্দেহ করে বেশ কয়েকজন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এর মধ্যে মানিকগঞ্জের তিনটি আসনেই বিএনপির প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিলের পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে এসব মনোনয়ন গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসব আসনে মনোনয়ন গ্রহণ করা হয়।