মিজানুর রহমান, হরিপুর (ঠাকুরগাঁও) : ঠাকুরগাঁওয়ে রাণীশংকৈলে উদ্ধার হওয়া বিলুপ্ত প্রজাতির সেই গর্ভবতী নীলগাইটি মৃত বাচ্চা প্রসব করায় আর বংশবৃদ্ধি সম্ভব হলো না বাংলাদেশে। বংশবৃদ্ধির জন্য পুরুষ নীলগাইয়ের সন্ধান করছে বন বিভাগ। এদিকে নীলগাইটির উদ্ধারকারীরা বলছেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আটক করে সরকারের হাতে তুলে দিয়েছি নীলগাইটি। বিনিময়ে আমরা কোনো কিছু পাইনি। নীলগাইটি যদি স্থানীয়রা সহজে দেখতে পারত, ভালো লাগত তাহলে। উদ্ধার করলাম আমরা, দেখছে দিনাজপুরের মানুষ।’

বন বিভাগ বলছে, ঠাকুরগাঁওয়ে সরকারিভাবে প্রাণী সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় দিনাজপুরের রামসাগরের জাতীয় উদ্যানে হরিণের খাঁচায় রাখা হয়েছে নীলগাইটি।

ভারতের বনাঞ্চল থেকে আসা গ্রামবাসীর হাতে আটক প্রাণীটি আগের গর্ভধারণে মৃত বাচ্চা প্রসব করেছে গত ৯ সেপ্টেম্বর। তাকে প্রতিদিন দেখতে দিনাজপুরের রামসাগরে ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। বিশেষ প্রজাতির এই প্রাণীটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হবে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।

জানা যায়, বৃহত্তর দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের মাঠে-ঘাটে একসময় নীলগাইয়ের দেখা মিলত। এখন বিলুপ্ত হলেও এ অঞ্চলের মানুষের স্মৃতি থেকে নীলগাই মুছে যায়নি। বর্তমানে ভারতের কোনো কোনো প্রদেশে এ প্রাণীর দেখা মেলে এখনও। ছোট পাহাড় ও জঙ্গলে চরতে পছন্দ করে এরা। মহুয়া গাছের রসালো ফুল এদের দারুণ পছন্দ। পানি ছাড়াই দীর্ঘসময় কাটিয়ে দিতে পারে। স্ত্রী নীলগাই লালচে বাদামি, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নীলচে ধূসর হয়। জোছনা রাতে এরা দলবেঁধে মাঠে ঘাস বা ডালজাতীয় তৃণ খেতে বের হয়।

উদ্ধার হওয়া নীলগাইটির উচ্চতা চার ফুট। আর দৈর্ঘ্য সাড়ে পাঁচ ফুট। নামে নীলগাই হলেও গরুর মতো নয়, দেখতে অনেকটা বিদঘুটে চেহারার ঘোড়ার মতো। ঘাড়ে শূকরের মতো ঘন লোম আছে।

দিনাজপুর সামাজিক বন বিভাগের কর্মকর্তা ও রামসাগর জাতীয় উদ্যানের তত্ত্বাবধায়ক আবদুস সালাম তুহিন বলেন, নীলগাই বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রজাতির বন্যপ্রাণী। এটি এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় হরিণ। নীলগাইয়ের বৈজ্ঞানিক নাম ‘বোসেলাফাস ট্র্যাগোকামেলাস’। একশ’ বছর আগে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দেখা মিলত এর। তবে ১৯৪০ সালের দিকে পঞ্চগড়ে একবার দেখা গিয়েছিল। এর পর বাংলাদেশে আর কোথাও দেখা যায়নি। নীলগাইটির স্বাস্থ্য আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে। অসুস্থ অবস্থায় এটি মৃত পুরুষ বাচ্চা প্রসব করেছে। বাচ্চাটি জীবিত থাকলে সহজে প্রজনন ঘটিয়ে বংশবৃদ্ধি করা যেত। প্রাণীটি এলাকাবাসীর হাতে আটকের সময় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। অনেক পরিশ্রমে সুস্থ করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিদিন ১০০টি কলা, ৪৫০ গ্রাম ছোলা, ৫০০ গ্রাম মসুর ডাল ও গমের ভুসিসহ প্রয়োজনীয় খাদ্য দেওয়া হচ্ছে একে।

তিনি আরও বলেন, এই প্রাণীটির বংশবিস্তারের জন্য একটি পুরুষ নীলগাই প্রয়োজন। বন বিভাগ খোঁজ করছে- কোনোভাবে পুরুষ নীলগাই পেলে বংশবিস্তার ঘটানো যাবে।

উল্লেখ্য, বিলুপ্ত নীলগাইটি তিন-চার মাস ধরে সদর উপজেলার রহিমানপুর পটুয়া এলাকায় বসবাস করছিল। স্থানীয়দের ধারণা, ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এটি। ফসল নষ্ট করলে পাহারা দেয়ার সময় নীলগাইটি চিনতে পারে এলাকাবাসী। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তারা আটক করতে পারেনি এটি। গত ৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে সদর উপজেলার পটুয়া এলাকায় পথচারীরা ধাওয়া দিয়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দৌড়ে কুলিক নদী পার হওয়ার সময় পানিতে এটিকে আটক করে।

নীলগাইটি উদ্ধারের আগে সেটি দীর্ঘদিন ধরে থাকা ওই জঙ্গলের মালিক পটুয়া ফকদরপুর এলাকার আকরাম জানান, প্রায় তিন-চার মাস ভুট্টাক্ষেতে ছিল নীলগাইটি। পরে ভুট্টা না থাকায় তার আখক্ষেতে বসবাস করছিল।

নীলগাই উদ্ধারকারী জাহিদ বলেন, ‘উদ্ধার করার পর নিজের টাকা খরচ করে সুস্থ করেছি এটি। বন বিভাগের লোকজন এলে সুস্থ অবস্থায় বুঝিয়ে দিই তাদের হাতে। আমরা চাই, নীলগাইটি ঠাকুরগাঁওয়ে স্থায়ীভাবে রাখা হোক, যাতে সহজে দেখতে পারি আমরা।