দর্পণ ডেস্ক : কিংবদন্তি সম্পাদক, সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ছিলেন সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে আপসহীন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কখনো আপস করেননি। গত ১৩ আগস্ট তিনি নশ্বর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। আর পেছনে রেখে যান সাংবাদিকতায় পরিশ্রমী, বর্ণাঢ্য, সফল এক কর্মজীবন। যে জীবন উৎসর্গিত হয়েছিল শুধুমাত্র সাংবাদিকদের জন্য। এই পেশার প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল তার সরব উপস্থিতি। কর্মের ভেতর দিয়ে তিনি জীবনকে মহিমান্বিত করে গেছেন। তার জীবন ও কর্ম নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য শিক্ষনীয় হয়ে থাকবে।

প্রেস ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশের (পিআইবি) পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সমকালের প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুতে মঙ্গলবার পিআইবি পরিবার আয়োজিত শোকসভায় বিশিষ্টজনরা এসব কথা বলেন।

পিআইবির মহাপরিচালক শাহ আলমগীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্যসচিব আবদুল মালেক। আলোচনায় অংশ নেন সাবেক সাংসদ ও চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি, প্রধান তথ্য কর্মকর্তা কামরুন্নাহার, প্রথম আলোর যুগ্ম-সম্পাদক সোহরাব হাসান ও প্রয়াত গোলাম সারওয়ারের পরিবারের পক্ষে জামাতা মিয়া নাঈম হাবিব।

অনুষ্ঠানের শুরুতে গোলাম সারওয়ারের জীবনী পাঠ করেন শামীমা চৌধুরী। তার স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এছাড়া প্রয়াত সম্পাদকের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।

দেশের দক্ষিণ জনপদের তৃণমূল থেকে উঠে আসা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শে স্নাত গোলাম সারওয়ারের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানানোর জন্য এই শোকসভার আয়োজন করেছিল পিআইবি। এতে পিআইবি পরিবারের সদস্য ছাড়াও দেশের সাংবাদিকতা পেশার স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক জগতের বিশিষ্টজনরাও অংশ নেন। বিশেষ করে সাংবাদিকতা পেশার অনেকের স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় কিংবদন্তি দীক্ষাগুরু গোলাম সারওয়ারের ৫৩ বছরের পেশাগত জীবনের বিস্তৃত অধ্যায়ের জানা, অজানা অনেক কথা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রয়াত গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে তার স্মৃতিচারণ করে বলেন, তিনি ছিলেন আপদমস্তক একজন সজ্জন মানুষ। গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে সময়ের প্রয়োজনে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের নানাপর্বে তিনি শক্তহাতে কলম ধরেছেন। সামরিক শাসনামলে দেশকে যখন উল্টোপথে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হয়েছে, তখনও তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে অটল ছিলেন। বাংলাদেশকে ডিজিটাল সমাজে রুপান্তরের কার্যক্রমও তিনি দেখেছেন। জীবনের দীর্ঘ কয়েকটি পর্বে যে বর্ণাঢ্য সাংবাদিক জীবন তিনি পার করেছেন, সেখানে দক্ষ, সত্যনিষ্ঠ আর সাহসী একজন বার্তা সম্পাতক ও সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র ও ডিজিটাল বাংলাদেশে উত্তরণের পর্যায়ে আমরা যখন আছি, সেই সময়েই গোলাম সারওয়ার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

তিনি বলেন, গণমাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষার নামে রাজাকার, আগুন-সন্ত্রাসী ও খুনিদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক পাল্লায় মাপা চলবে না। গোলাম সারওয়ার কথাকথিত নিরপেক্ষতার নামে কোনোদিন তা করেননি। তিনি অমর ছিলেন, অমর থাকবেন।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেক বলেন, একজন সদালাপী, পরিশ্রমী ও আদর্শবান মানুষ হিসেবে প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ছিলেন অসাধারণ। তিনি অনায়াসে সত্যকে সত্য আর অসত্যকে অসত্য বলতেন। তার এই গুণের কারণেই তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন।

তিনি বলেন, গোলাম সারওয়ার একুশে পদক পেয়েছিলেন। তাকে আরও সম্মান দেয়ার প্রয়োজন আছে। সেটি আমাদের সকলের কর্তব্য।
তথ্যসচিব বলেন, দিনের শুরুতেই তিনি প্রথমে সমকাল পত্রিকা পড়েন। এরপর অন্যান্য পত্রিকা পড়েন।

অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান বলেন, গোলাম সারওয়ার যতোটা সম্পাদক ছিলেন, তারও চেয়ে ছিলেন বড় বেশি বার্তা সম্পাদক। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা প্রায় অতিমানবীয়। ছিলেন নিপাট ভদ্রলোক। এদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে তার নাম খুব ভালোভাবেই লেখা হবে।

জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, তিনি গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে ৩০ বছর কাজ করেছেন। গোলাম সারওয়ার বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে কোনোদিন আপস করেননি। বস্তুনিষ্ঠ কোনো তথ্য কখনো গোপন করেননি। ‘নিউজ রুম এডিটর’ অভিধা কেবলই গোলাম সারওয়ারের জন্যই মানায়।

ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, অনুজপ্রতীম সাংবাদিকদের জন্য গোলাম সারওয়ার ছিলেন আদর্শ। তার কাছ থেকে আমরাও প্রতিনিয়ত শিখতাম। তার কাজগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে।

তিনি বলেন, গোলাম সারওয়ারের সাহিত্যপ্রীতি ছিল ভীষণ রকম। তার প্রতিটি লেখায় তার পরিচয় মেলে। সাহিত্য ছাড়া সাংবাদিকতা হয় না।

সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান বলেন, কাজের নেশাগ্রস্ত একজন মানুষ ছিলেন গোলাম সারওয়ার। বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি।

সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, গোলাম সারওয়ার কেবল সাংবাদিকতার বাতিঘর ছিলেন না, জাতি ও রাষ্ট্রেরও তিনি বাতিঘর ছিলেন। সৃষ্টিশীল মানুষ কখনো মরেন না। তিনিও তার কর্মের মাধ্যমে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। যে আলো তিনি রেখে গেছেন, সে আলোর পথ ধরে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম সামনে এগিয়ে যাবে।

প্রথম আলোর যুগ্ম-সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, বার্তা সম্পাদক পদটিকে গোলাম সারওয়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন। অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস তিনি সামরিক শাসনামলে দেখিয়েছিলেন।

প্রধান তথ্য কর্মকর্তা কামরুন্নাহার বলেন, গোলাম সারওয়ার ছিলেন ভালো শিক্ষক। আমি নিজে তার কাছে ফটো সম্পাদনা শিখেছি। জ্ঞানবান ও প্রজ্ঞাবান ছিলেন। তার পরামর্শ আমাদের পাথেয়।

চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী বলেন, পূর্বাণী পত্রিকার মাধ্যমে গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে পরিচয়। দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধু তিনি। অতি কাছের মানুষ, অতি চেনা। শিশুর মতো সরলভাবে সবার সঙ্গে মিশতেন। তার বই ‘অমিয় গরল’ প্রকাশের সময় মোড়ক উন্মোচনে ডেকেছিলেন। তার মতাে গুণী মানুষ মেলা ভার।

প্রয়াতের জামাতা মিয়া নাঈম হাবিব স্মৃতিচারণ করে বলেন, ছোটবেলায় তিনি বাবা হারিয়েছিলেন। গোলাম সারওয়ার বেঁচে থাকাতে তিনি কখনো মনে করতেন না, তার বাবা নেই।

সভাপতির বক্তৃতায় শাহ আলমগীর বলেন, ‘নিরীক্ষা’র পরবর্তী সংখ্যায় গোলাম সারওয়ারের লেখাসহ বিশেষ সংখ্যা থাকছে। পিআইবির পরিচালনা বোর্ড সভায় তারা গোলাম সারওয়ারের স্মৃতি রক্ষার্থে কী করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।