দর্পণ ডেস্ক : ২১ আগস্ট নারকীয় সেই গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯জনের যাবজ্জীবন ও বাকি ১১ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীবিরোধী সমাবেশে ১৪ বছর আগে নৃশংস ওই গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল; বুধবার ১২টায় তার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
১৪ বছর আগে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ নৃশংস ওই গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। আজ তার বিচার মিলেছে।
এক নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন বেলা ১২টায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা আলোচিত দুই মামলার রায় ঘোষণা করেন।
নাজিমউদ্দিন রোড এ রায় ঘিরে সকাল থেকেই ও আশপাশের এলাকায় নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে আছেন।
দুই মামলার ৪৯ আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা ৩১ আসামিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকায় পাঠানো হয় সকালেই। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ বাকি ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচারকাজ চলে।
ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া মঙ্গলবার বলেছিলেন- এ রায় ঘিরে রাজধানীতে কোনো নিরাপত্তা হুমকি তারা দেখছেন না। তার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে থাকবে।
বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে সকাল ৮টা থেকে পলাশীর মোড়, বকশিবাজার মোড়, শিক্ষা বোর্ডের সামনে, চকবাজার, মৌলভীবাজার বাজার মোড় ও নয়াবাজার এলাকায়।
পৃথক চারটি মামলা এ ঘটনায় করা হয়। মামলাগুলো একসঙ্গে তদন্ত করে হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে পৃথক দুটি চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়া হয়। ভয়াবহ সেই ঘটনার ১৪ বছর এক মাস ২০ দিন পর চাঞ্চল্যকর এ দুটি মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে। এ রায় কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, অপরাধ জগতের ইতিহাসে গ্রেনেড হামলার ঘটনা একটি জঘন্যতম অপরাধ। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ও তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে ‘হালকা নাস্তার (অপরাধীর দেয়া সাংকেতিক নাম)’ নামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ২৪ জনকে হত্যা করার অপরাধ কেন্দ্র করে দুটি মামলা হয়। একটি হত্যা ও অন্যটি বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলা। জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে দুটি মামলাই তদন্তে ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ মামলা অধিকতর তদন্তে যায়।
৫২ আসামির মধ্যে তিনজনের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় বর্তমানে আসামি ৪৯ জন। ওই হামলার অর্থের জোগান ও প্রশাসনিক সহায়তায় ছিল চার-দলীয় জোট তথা বিএনপি-জামায়াত সরকার।
দুটি মামলায় একজনকেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আসামি করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। রেজাউর রহমান বলেন, সারা দেশের বিচারপ্রার্থী মানুষ এ রায়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আইনের বিধান অনুযায়ী আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছি। ২২৫ সাক্ষীর মাধ্যমে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে প্রমাণে সক্ষম হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
অন্যদিকে আসামিপক্ষে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং সাবেক দুই আইজিপি- মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হকের আইনজীবী এম নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মাধ্যমে আসামি করা হয়েছে।
কিন্তু মুফতি হান্নানের সেই জবানবন্দি সঠিক মর্মে প্রমাণ হয়নি। এ দুজনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। প্রথম দফায় দাখিল করা চার্জশিটে ওই তিনজন আসামি ছিলেন না। সম্পূরক চার্জশিটে ওই তিনজনকেই আসামি করা হয়েছে। নির্দোষ দাবি করে আসামিরা বেকসুর খালাস পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সম্পূরক চার্জশিটে (অভিযোগপত্র) বলা হয়েছে, তৎকালীন চার-দলীয় জোট সরকারের শীর্ষপর্যায়ের ইন্ধনে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশসহ (হুজি) তিনটি জঙ্গি সংগঠন ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় ইতিহাসের ভয়াবহতম নৃশংস ও বর্বরোচিত ওই হামলার ঘটনা ঘটে।
এতে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জনের মৃত্যু হয়। হামলায় আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী। আর অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি এ মামলায় সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে রাষ্ট্রপক্ষ। ৪৯২ সাক্ষীর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষে ২২৫ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। আর আসামিপক্ষে ১২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
মামলায় ১৪৪ আলামত ও ৫৫টি বস্তু প্রদর্শন করা হয়েছে। গত বছরের ৩০ মে এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শেষ হয়। আর গত বছরের ১২ জুন মামলায় ৩১ আসামির আত্মপক্ষ শুনানি শেষ হয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও আনসার-ভিডিপির সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিনসহ ১৮ আসামি পলাতক থাকায় তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি।
পলাতক আসামিদের মধ্যে ১৪ জনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আইনজীবী নিযুক্ত করা হয়।