অনলাইন ডেস্ক : ঝর্ণা রানী ভৌমিককে ভুলতে পারছেন না এলাকাবাসী। তার মতো মায়াবী মানুষ এ এলাকায় দ্বিতীয়জন ছিলেন না। তাই পুরো মহল্লার মানুষ আজও শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ঝর্ণার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করে তাকে স্মরণ করেন। এদিকে, পরিবারে আর্থিক দৈন্যদশার কথা চিন্তা করে ঝর্ণা রানীর বড় ছেলে বাসুদেব ভৌমিককে একটি বেসরকারি (এনআরবি গ্লোবাল) ব্যাংকে চাকরি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঝর্ণা রানীর পরিবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তারপরও ভালো নেই তারা।
ঝর্ণা রানীর সবচেয়ে আদরের ছোট ছেলে শুভ দেব ভৌমিকের বয়স ১৩ বছর। মায়ের মৃত্যুর পর তাকে ময়মনসিংহ মুকুল নিকেতনের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু মেধাবী এই ছেলেটির জন্য প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই পরিবারটির। তাই তাকে কিশোরগঞ্জ আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। বাবা গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিক কিশোরগঞ্জ সুবোধ বিড়ি ফ্যাক্টরিতে কর্মরত ছিলেন। প্রায় আট মাস আগে ফ্যাক্টরির অবস্থা ভালো নয় বলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। পরিবারের রোজগার বলতে এখন শুধু বাসুদেবের সামান্য উপার্জন।
এলাকাবাসী জানান, প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের দিন মুসলিম সম্প্রদায়ের মতোই ঘরে নানারকম রান্নার আয়োজন করতেন ঝর্ণা রানী। সেমাই-পায়েশ, চালের রুটি আর মুরগির মাংস রান্না হতো তার ঘরে। ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসতেন বড় ছেলে বাসুদেব ভৌমিক। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তুমুল আনন্দে মেতে উঠতেন তারা। প্রতিবছরের মতো ২০১৬ সালের ৭ জুলাই রোজার ঈদেও বিচিত্র আয়োজন করেছিলেন ঘরে। ভোরবেলা থেকে শোলাকিয়ায় নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের তিনি সুপেয় পানি আর বাতাসা দিয়ে বাড়ির সামনে চেয়ার-টেবিল পেতে আপ্যায়নে বসেন। এই ব্যস্ততার মধ্যে পৌনে ৯টার দিকে ঈদগাহ মাঠে জঙ্গি হামলার খবর পেয়ে ঘরে আশ্রয় নেন। কিন্তু ঘরের জানালা ভেদ করে আসা একটি বুলেটে মুহূর্তেই ঝর্ণা রানী রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন ঘরের মেঝেতে। প্রাণ হারান তিনি। ওইদিন জঙ্গিগোষ্ঠীর আকস্মিক হামলায় দুই পুলিশ সদস্যসহ ঝর্ণা রানী নিহত হন।
আজ সেই শোলাকিয়া ট্র্যাজেডির দুই বছর পূর্ণ হলো। এ দুই বছরে শহরের অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। শহরের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও ঘটেছে আমূল পরিবর্তন। কিন্তু নিহত ঝর্ণা রানীর পরিবারে স্বজন হারানোর মাতম আজও থামেনি। ঈদের দিন এলেই বুকফাটা কান্নার আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে চর শোলাকিয়ায় অবস্থিত ঝর্ণা রানীর ছোট্ট বাড়ির আঙিনা।
ঝর্ণা রানীর স্বামী গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিক বলেন, ‘ঝর্ণাকে হারিয়ে পরিবারের সবকিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশীদের মূল্যায়ন দেখে মনে করি এক মহিয়সী নারীর ভাগ্যবান স্বামী ছিলাম। ঝর্ণা সবুজবাগ এলাকায় সবার এত প্রিয়ভাজন ছিলেন, তা কখনও টের পাইনি।’
ঝর্ণা রানীর নামে শোলাকিয়া রাস্তার নামটি শহীদ ঝর্ণা রানী সড়ক করায় গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিক কিশোরগঞ্জ পৌরসভার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘জঙ্গি হামলায় নিহত একজন সাধারণ নারীর আত্মাহুতির প্রতি পৌর কর্তৃপক্ষের এই স্বীকৃতি অন্যান্য মানুষের মধ্যেও জঙ্গিবিরোধী মানসিকতা তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।’
ভৌমিক পরিবারের সদস্যরা জানান, আজ ৭ জুলাই ঝর্ণা রানী ভৌমিকের স্মরণে বাড়িতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে পরিবারের লোকজনসহ এলাকাবাসী উপস্থিত থেকে ঝর্ণা রানীর জন্য প্রার্থনা করবেন।