এম নাঈম হোসেন

বর্তমান সময়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে প্রশ্নটি সার্বক্ষণিক আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো ‘করোনাযুদ্ধের শেষ কবে এবং কখন আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসব?’ এই প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারোরই জানা নেই। এই মুহূর্তে (৯ মে ২০২০ সকাল) মানসিকভাবে আমরা সবচেয়ে ভয়ংকর সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। কারণ, শুক্রবার আমাদের দেশে একদিনে নতুন আক্রান্তের সংখ্যাটি ছিল ৭০৯ জন, যার মধ্যদিয়ে সর্বমোট আক্রান্ত ১৩ হাজার ছাড়িয়েছে। ধারণা করা যাচ্ছে, আমাদের দেশে দ্বিতীয় পর্যায় মহামারির ঊর্ধ্বগতিতে আছে, তাই প্রতিদিনকার আক্রান্তের সংখ্যাটি বাড়ন্তের দিকে। এতে ভীত হওয়ার কারণ নেই। কারণ, দুর্ভাবনা ও ভীতি মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। কারণে-অকারণে অন্যকে দোষারোপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে নিজের মানসিক শক্তির ক্ষয় হয়। সব সময়ই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে- এটাই এখন একমাত্র ঢাল।
এ লেখার সময় পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডওমিটারসের (www.worldometers.info)দেয়া তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে একটি বিশ্লেষণধর্মী ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা দেখে আমরা সাধারণ নাগরিকরা কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারব, আমাদের দেশে প্রতিদিনকার নতুন আক্রান্তের সংখ্যাটি কবে থেকে কমতে পারে। এই বিশ্লেষণধর্মী ধারণাটি করতে সর্বপ্রথম একটি মহামারির জীবনচক্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়া জরুরি। মহামারির জীবনচক্রে ৫টি পর্যায় থাকে: ১ম পর্যায় প্রাদুর্ভাব (প্রকাশ), ২য় পর্যায় গতিবেগ বৃদ্ধি (ঊর্ধ্বগতি), ৩য় পর্যায় সর্বোচ্চ চূড়া (আনতি বিন্দু), ৪র্থ পর্যায়Ñহ্রাস এবং ৫ম পর্যায় সমাপ্তি।
এই বিবরণীতে শুধু প্রতিদিনকার নতুন আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করা হবে। কারণ, মহামারির জীবনচক্রের পাঁচটি পর্যায় সহজভাবে বুঝতে গেলে এই সংখ্যাটি আমাদেরকে সাহায্য করবে। প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, একটি নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডওমিটারসের তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই বিবরণীটি একটি বিশ্লেষণধর্মী অনুমান মাত্র, দেশের চলমান বাস্তবতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পিত অনুমানগুলোর পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
পুরো পৃথিবী করোনাযুদ্ধের কোন পর্যায়ে আছে : পুরো পৃথিবীতে ওয়ার্ল্ডওমিটারসের তথ্যমতে, করোনা মহামারির শুরু ২২ জানুয়ারি ২০২০। সেদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫৮০ জন। এটাকে বলা যেতে পারে প্রথম পর্যায় মহামারির প্রাদুর্ভাব (প্রকাশ)। এই সংখ্যাটি কোভিড-১৯ গ্রাফের শুরু। এর পর সংখ্যাটি পৃথিবীজুড়ে বাড়তে শুরু করে, যেটি হচ্ছে মহামারির দ্বিতীয় পর্যায়Ñগতিবেগ বৃদ্ধি (ঊর্ধ্বগতি)। দ্বিতীয় পর্যায় শুরুর ৩০ দিনের মাথায় (২২ ফেব্রুয়ারি) সংখ্যাটি হয়ে যায় ৯৭৮ জন, আর ৬০ দিনের (২২ মার্চ) মাথায় ২৯,৪৬৯ জন। ৯৩ দিনের (২৪ এপ্রিল) মাথায় এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১,০৫,৮২৫ জনে। সেদিন এটি তৃতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ চূড়া (আনতি বিন্দু) স্পর্শ করে। এর পরদিন থেকেই সংখ্যাটি নামতে শুরু করে এবং বুধবার ১০৮তম দিনে (৯ মে) পুরো পৃথিবীতে সংখ্যাটি হচ্ছে ৯৭,১২৮ জন। তার মানে পৃথিবী এখন করোনা মহামারির চতুর্থ পর্যায়ে (হ্রাস-পর্বে) অবস্থান করছে এবং অন্য সব বিষয় ঠিক থাকলে (Ceteris Paribus) এটি সামনেই কোনো এক সময় সমাপ্তির দিকে যাবে।
কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান প্রকাশ চূড়ায় পৌঁছানো এবং বর্তমান পর্যায় : ওয়ার্ল্ডওমিটারসের তথ্যানুযায়ী ৯ মে ২০২০ সকাল পর্যন্ত আমরা উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি দেশের প্রতিদিনের নতুন আক্রান্তের সংখ্যাগুলো একটু পর্যালোচনা করে দেখি, তারা কতদিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেছে এবং এ মুহূর্তে কোন পর্যায়ে আছে।
দ্রুততম কয়েকটি দেশের উদাহরণ (১৭-৩৫তম দিনে চূড়ায়)
দক্ষিণ কোরিয়া : ১৭তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (৮৫১ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২৮ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ১২ জন, বর্তমানে ৫ম পর্যায়Ñমহামারি সমাপ্তির পথে।
চীন : ২১তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (১৪,১০৮ জন); ১ম দিন ২২ জানুয়ারি ৫৭১ জন, ১০৮তম দিনে (৯ মে) ১ জন, বর্তমানে ৫ম পর্যায় মহামারি সমাপ্তির পথে।
নিউজিল্যান্ড : ২৯তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (১৪৬ জন); ১ম দিন ২৮ ফেব্রুয়ারি ১ জন, ৭১তম দিনে (৯ মে) ০ জন, বর্তমানে ৫ম পর্যায় মহামারি সমাপ্তির পথে।
ইতালি : ৩৫তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (৬,৫৫৭ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ১৩২৭ জন, বর্তমানে ৪র্থ পর্যায় মহামারির হ্রাস পর্বে আছে।
পর্যায়গুলো দেরিতে অতিক্রম করা কয়েকটি দেশের উদাহরণ (৬৯-৮২তম দিনে চূড়ায়)
যুক্তরাষ্ট্র : ৬৯তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (৩৮,৯৫৮ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৫ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ২৯,১৬২ জন, বর্তমানে ৪র্থ পর্যায় মহামারি হ্রাস পর্বে আছে।
সুইডেন : ৬৯তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (৮১২ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ৬৪২ জন, বর্তমানে ৪র্থ পর্যায় মহামারি হ্রাস পর্বে আছে।
পাকিস্তান : ৭২তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (১৭৯১ জন); ১ম দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি (২ জন), ৭৩তম দিনে (৯ মে) ১৭৯১ জন, বর্তমানে ২য় পর্যায় মহামারির ঊর্ধ্বগতিতে অবস্থিত।
রাশিয়া : ৮২তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (১১,২৩১ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ১০,৬৯৯ জন, বর্তমানে মহামারির ঊর্ধ্বগতি অথবা হ্রাস পর্বে আছে (পরবর্তী দিনগুলোয় বোঝা যাবে)।
ইউরোপের কয়েকটি দেশের উদাহরণ (৪০-৫৫তম দিনে চূড়ায়)
স্পেন : ৪০তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (৮২৭১ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ৩,২৬২ জন, বর্তমানে ৪র্থ পর্যায়Ñমহামারি হ্রাস পর্বে আছে।
জার্মানি : ৪১তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (৬৯৩৩ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৬ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ১,১৫৮ জন, বর্তমানে ৪র্থ পর্যায়Ñমহামারি হ্রাস পর্বে আছে।
ফ্রান্স : ৪৮তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (১৭,৩৫৫ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১২ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ১,২৮৮ জন, বর্তমানে ৪র্থ পর্যায় মহামারি হ্রাস পর্বে।
যুক্তরাজ্য : ৫৫তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (৮৬৮১ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ৯ জন, ৭৩তম দিনে (৯ মে) ৪,৬৪৯ জন, বর্তমানে ৪র্থ পর্যায় মহামারি হ্রাস পর্বে।
এশিয়ার কয়েকটি দেশের উদাহরণ (৫৬-৭৯তম দিনে চূড়ায়) : জাপান : ৫৬তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (৭৪১ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ৫৩ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ৯৮ জন, বর্তমানে ৪র্থ পর্যায় মহামারি হ্রাস পর্বে অবস্থিত।
সিঙ্গাপুর : ৬৫তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (১৪২৬ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ৭২ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ৭৬৮ জন, বর্তমানে ৪র্থ পর্যায় মহামারি হ্রাস পর্বে অবস্থিত।
শ্রীলংকা : ৭১তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (৭১ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ১২ জন, বর্তমানে ৪র্থ পর্যায় মহামারি হ্রাস পর্বে অবস্থিত।
ভারত : ৭৯তম দিনে সর্বোচ্চ চূড়ায় (৩৯৩২ জন); ১ম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩ জন, ৮৪তম দিনে (৯ মে) ৩,৩৪৪ জন, বর্তমানে মহামারির ঊর্ধ্বগতি অথবা হ্রাস পর্বে আছে (পরবর্তী দিনগুলোয় বোঝা যাবে)।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান চূড়ায় পৌঁছানো এবং হ্রাস পর্ব : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি, বাংলাদেশ কবে চূড়ায় পৌঁছবে? আজ ৯ মে, ২০২০ সকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা যদি দেখি, মোট নমুনা পরীক্ষা ১,১১,৪০১ জন, মোট আক্রান্ত ১৩,১৩৪ জন (১১.৮%), মোট মৃত্যু ২০৬ (১.৫৭%), মোট সুস্থ ২,১০১ জন (১৬%)। ওয়ার্ল্ডওমিটারসের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত ৮ মার্চ, ২০২০ (৩ জন), ৩০ দিনের মাথায় (৮ এপ্রিল) নতুন আক্রান্তের সংখ্যাটি ছিল ৫৪ জন। আজ ৬২তম দিনে (৯ মে) নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ৭০৯ জন। কিন্তু এটাই কি আমাদের সর্বোচ্চ চূড়া, নাকি আরও কিছুদিন লাগবে সেটি সময় বলতে পারবে।
যদি আমরা ইতোমধ্যে চূড়ায় পৌঁছে না থাকি এবং উপরের উদাহরণগুলোর মধ্যে এশিয়ার দেশগুলোর মতো আচরণ করি, তাহলে ৩-২৬ মে’র (৫৬-৭৯তম দিন) কোনো এক সময় চূড়ায় পৌঁছুতে পারি (অনুমান)। যদি উদাহরণের সবচেয়ে দেরিতে পৌঁছানো দেশগুলোর মতো সময় নিয়ে ফেলি, তবে আমরা চূড়ায় পৌঁছুতে পারি ১৬ মে-২৯ মে’র (৬৯-৮২তম দিন) আশপাশের কোনো এক সময় (অনুমান)। যদি এখানেও করোনাভাইরাস সমগ্র পৃথিবীর মতো আচরণ করে তাহলে ৯ জুন, ২০২০ (৯৩তম দিনে)-এর আশপাশের কোনো এক সময় আমরা চূড়ায় পৌঁছাব (অনুমান)। আর যদি বিশ্বরেকর্ড করার ব্যাপার ঘটে তাহলে আরও দেরিতে!
আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়, বুধবার পর্যন্ত আমাদের মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ১ লাখের উপরে। প্রথমদিকে আমাদের দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫০০ জনের মতো, বর্তমানে যেটি আনুমানিক ৬,০০০ জনের আশপাশে। সুতরাং প্রতিদিনকার আক্রান্তের সংখ্যাটিও নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে স্বাভাবিকভাবেই একটু বাড়তি পর্যায়ে থাকবে, এ কারণেও সর্বোচ্চ চূড়ার সংখ্যাটি পেতে হয়তো একটু দেরি হয়ে থাকতে পারে।
লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি, শৃঙ্খলা যত বেশি মেনে চলা হবে, ততোই দ্রুত সর্বোচ্চ চূড়া এবং হ্রাস পর্বে চলে আসা সম্ভব। মেনে না চললে চূড়ায় পৌঁছানোর পরও হ্রাস পর্বের গ্রাফের লেজটি আরও অনেক বেশি লম্বা হয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমাদের দরকার সব নিয়মকানুন মেনে চলা এবং একান্তই প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে না যাওয়া।
৫ম পর্যায় করোনার সমাপ্তি : ইতিহাস বলে যে কোনো মহামারি কয়েক ধাপেও হতে পারে। আজকের প্রবন্ধে শুধুই কোভিড-১৯-এর ১ম ধাপে আমাদের অবস্থান নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। ২য় বা ৩য় ধাপের সম্মুখীন হতে না চাইলে, ১ম ধাপের সমাপ্তির পরও বেশ কিছুদিন সুশৃঙ্খলিত স্বাস্থ্যবিধি ও নিয়মকানুন মেনে চলা জরুরি। একমাত্র প্রতিষেধক টিকার আবিষ্কারই পারে একটি মহামারির সম্পূর্ণ সমাপ্তি টানতে।
নিজেকে এবং পরিবারকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখার জন্য যা করণীয় সবকিছু নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজেদের করতে হবে। কাজেই অকারণে আতঙ্কিত হবেন না, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, সরকারের নির্দেশ মেনে চলুন, নিজেকে, পরিবার ও সমাজকে সুরক্ষিত রাখুন। আজ হোক, কাল হোক, ইনশাআল্লাহ বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।
(যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে পরে আরেকটি বিবরণী তুলে ধরার চেষ্টা করব ‘বাংলাদেশের করোনাযুদ্ধ বনাম জীবিকাযুদ্ধ’।)

লেখক : এম নাঈম হোসেন, সভাপতি, নাগরিক ঢাকা।