হিংসার বশবর্তী হয়ে মানুষ তার স্বজাতিকেই মেরে-কেটে বাড়িছাড়া করতে পিছপা হয় না। বর্ণভেদের কারণে, ধর্মের কারণে, স্বার্থের কারণে মানুষ মানুষকে কতভাবেই না অশান্তির আগুনে পুড়িয়ে দেয়। মানুষেরই ভয়ে মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালায়।
কিশোর বয়সের কাছে অবশ্য বাড়ি ছেড়ে পালানোর ভিন্ন একটা অর্থ ও বাস্তবতা আছে। কিন্তু আমার সেই বয়সেই আমি দেখলাম ধর্মের কারণে বিভক্ত হয়ে মানুষ মানুষকে প্রতিহিংসার আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে, বাড়িছাড়া করেছে।
আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগে- বাংলাদেশ তখনও গ্রামপ্রধানই ছিলো। সেই সময়ে ছেলেদের দুষ্টুমি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে-বেড়ানোর ঘটনা স্বাভাবিক ব্যাপারই ছিলো। ঘুরতে ঘুরতে কারও বাড়িতে খেতে পেলে খেত, কিংবা রাস্তায় পথে-ঘাটে-মাঠে খাবার মতন কোনো জিনিস যেমন বনকুল, বৈচি এসব পাওয়া গেলে খেত। বলা যায়, গ্রামের ছেলেপেলেদের অভ্যেসই ছিলো এ রকম আরকি। তবে সেটাকে ঠিক বাড়ি থেকে পালানো বলা যায় না। কারণ দিনের শেষে ঠিকই আবার সে ঘরে ফিরে আসতো। সকাল বেলায় বাড়িতে হয়তো অল্পকিছু একটা খেয়েছে কি খায়নি- তারপরে আর তার কোনো পাত্তা নেই। কোথায় গেলরে! কোথায় গেলরে! বাড়ি থেকে পালিয়েই গেল নাকি- বাড়ির লোকেরা এরকম কথা বলাবলি করতো সারাদিন। তবে বাড়ি থেকে পালিয়ে একেবারে অন্য কোথাও চলে যাওয়া, এবং আদৌ না ফেরা, অনেক বছর পরে ফেরা বা অল্প বয়সের ছেলে যখন ফিরলো তখন তার অনেক বয়স হয়ে গেছে- এইসব ব্যাপার থেকে তা আলাদা।
বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার ঘটনা আমাকে বেশ আকর্ষণ করে। তবে আমি সে অর্থে কখনও বাড়ি থেকে পালিয়ে যাইনি। হয়তো সকাল বেলা কিছু একটা খেয়ে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি; সারাদিন আর বাড়ি ফেরার নাম নেই। আমাদের রাঢ় দেশটা একটা প্রান্তরের দেশ তো- খুব দূরে দূরে দু’একটা বাড়ি, দূরে একটা গ্রাম ধোঁয়ার মত দেখা যায়। অনেক দূরের আকাশের নিচে আবছা কিছু ঘরবাড়ি। সেখানে চলে যাবার ইচ্ছায় আমাদের অনেকেই বেরিয়ে পড়তাম কোনো কোনোদিন। কিন্তু তাকে তো আর বাড়ি ছেড়ে পালানো বলা যায় না।
আরেক রকম পালানোর কথা বলা যায় যে, হয়তো বয়স হয়েছে, সংসারের বোঝা আর টানতে পারছে না। নানারকম চাপে পড়ে ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আর তাকে পাওয়া গেল না। তারপরে দেখা গেল, স্ত্রীর অভাব মেটাতে না পেরে, কিংবা একটা শাড়ি কিনে দিতে না পেরে পালিয়ে গেল। কিংবা বহুদিন পর হয়তো খবর পাওয়া গেল যে, কোথায় বিদেশে কোন একটা জায়গায় সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। হয়তো সেখানেই সৎকার করেছে বা কবর দিয়েছে বা দেয়নি।
ঘর থেকে পালিয়ে যাবার এমন অনেক মানে আছে, অনেক রকম আছে। দশ বছর আগে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া লোক হঠাৎ এসে হাজির হওয়ার ঘটনাও আছে। অনেকের তো ঘরই নেই, পালাবে কি! তারা সারা জীবন ধরেই পালিয়ে বেড়ায় উদ্বাস্তুর জীবন।
আরেক ধরনের পালানোর কথা বলি এবার। প্রাণের ভয়ে ভিটে-মাটি বাড়ি-ঘর সব ফেলে পালানোর গল্প সেটা। ধর্মীয় আর রাজনৈতিক হিংসার কোপে পড়ে সারা পৃথিবীতেই মানুষকে নানা সময়ে পালাতে হয়েছে। এ উপমহাদেশেও হয়েছে। দলে দলে মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। জীবন বাঁচানোর জন্য দখলদারদের ভয়ে, এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষের ভয়ে পালিয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সেই ভূত এখনও ঘুরছে এ উপমহাদেশে। বিরাট অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ একেবারে চলে যাওয়ার ঘটনা তো ঘটেছে আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেই।
দাঙ্গা, মারামারি, কাটাকাটির আঁচ আমি পেয়েছিলাম কিশোর বয়সেই। সেই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা দেখছি আজও একই রকমভাবে জ্বলে উঠেছে।
দুই.
ছোটবেলায় মাস্টার মশাইয়ের বাড়িতে কিংবা গাঁয়ের আরও অনেক হিন্দু বাড়িতে পুজোর প্রসাদ বেশ মজা করেই খেতাম আমরা। সে বয়সেই কোনো কোনো বন্ধু দেখতাম বলে উঠতো- হিঁদুদের পুজোর প্রসাদ আবার খেতে আছে নাকিরে! দেখবি, হিঁদু হয়ে যাবি। না-হয় মা কালীর পাঁঠা হয়ে গিয়ে ব্যা-ব্যা করবি। প্রসাদ খেলে গুনা হবে।
কিন্তু এসব কথায় আমি তেমন কান দিতাম না। ভাবতাম, গুনা হয় হোক। আমি এসব নিয়ে কাউকে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞেস করতে যাইনি। আসল কথা গন্ধভরা আলো চাল, দুধ, কলা, চিনি, বাতাসা- এসব দিয়ে যে-ই মাখুক হাড়ি, ডোম, হিন্দু, মুসলমান- খেতে কিন্তু চমৎকার।
এমন বহু সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা তখন গাঁয়েও প্রচলিত। তারও অনেক দিন পরে, গ্রামের আকাশে সূর্য আছে ঠিক। কিন্তু আমি দেখছি যে, সূর্য নিভে গেছে- সারা গাঁয়ে ভীষণ ঠান্ডা ছায়া। সূর্য ডোবার দিন সুবল শুধু একবার বলেছিলো, রায়েদের লক্ষ্মীদা কলকাতায় মোচনদের হাতে কাটা পড়েছে। তবে ও বলেনি যে, তোরা কেটেছিস লক্ষ্মীদাকে। শুধু বললো, মোচনরা মানে মুসলমানরা কেটেছে। যেন আমি মোসলমান নই, আমাদের গাঁয়েও কোনো মোসলমান নেই।
ক’দিন থেকেই শুনছি- হিন্দুরা বলছে, কলকাতায় কাটাকাটি হচ্ছে। মোসলমানরা বলছে, সেখানে হিড়িক লেগেছে হিন্দুতে আর মোসলমানে। ‘হিড়িক’ আর ‘কাটাকাটি’- একটা মোসলমানদের শব্দ, আরেকটা হিন্দুদের।
কিন্তু আমি ভাবি যে লক্ষ্মীদাকে কেটে ফেলেছে। এ কথার মানেটা কী! লক্ষ্মীদা কি লাউ না কুমড়ো যে, তাকে ঘ্যাঁচ করে কেটে ফেলবে? মোসলমানরা কেটেছে- তার মানেই বা কী? আমি কোনোদিন লক্ষ্মীদাকে কাটবো না। সে আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। গাঁয়ের মোসলমানরাও কাটবে না। কিন্তু কলকাতার মোসলমানরা লক্ষ্মীদাকে কেটে ফেললো অমনভাবে!
কাউকে খচাং করে কাটা কি সোজা কথা? তবে পরে তো বুঝেছি, লক্ষ্মীদাকে কেউ রাগ করে মেরেছে; তা নয়। মোসলমানরা মোসলমান বলে আর হিন্দুরা হিন্দু বলে মেরেছে। জন্মের আগে লক্ষ্মীদা কি কাউকে বলতে গেছে যে, আমাকে হিন্দু করে দাও না। যে মোসলমানরা তাকে মেরেছে তারা কি জন্মের আগে কাউকে বলতে পেরেছে যে, আমাদের মোসলমান করে দেবে কিন্তু।
আর কারো কিছু হলো না। কেবল আমার কাছে দপ করে সূর্যটা নিভে গেল। চারদিকে এত আলো, অথচ আমি দেখি সব মিয়ানো। যেন বৃষ্টি হবে, সবাই চাপা পড়ে যাবে। খালি মনে হচ্ছে, কারা যেন আমার ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে।
আচ্ছা, কীভাবে মেরেছে রোগা-পটকা কবুতরবুকো লক্ষ্মীদাকে? ঘরের ভিতরে, বাড়ির উঠোনে, নাকি রাস্তায়? সকালে, দুপুরে, না সাঁঝে? কতজন মেরেছে, কী দিয়ে মেরেছে? কোপ পড়ার আগে কি হাত তুলেছিলো লক্ষ্মীদা?
আমার সেই বয়সে এ রকম মনে হচ্ছিলো। কিন্তু কেন মনে হচ্ছিলো? সুবল যে কথা বলেছিলো সেদিন, সে কথা আগে কখনো শুনিনি আমি।
তাই আবার হয় নাকি! বলা নেই কওয়া নেই, যে-ই জানা গেল লোকটা মোসলমান অমনি একজন বা দশজন হিন্দু এসে তাকে ছোরাছুরি মেরে খুন করবে! কিংবা যেই দেখা গেল একটা ধুতি পরা হিন্দু, অমনি এক দল মোসলমান এসে তাকে জবাই করে ফেলবে? এরকম কথা সম্ভবত আমাদের কারো মাথায়ই ছিলো না এর আগে। অথচ যেই না শোনা গেল রায়বাড়ির লক্ষ্মী কলকাতায় কাটা পড়েছে, অমনি তারপর থেকে গাঁয়ের হিন্দু আর মোসলমানপাড়ায় হিন্দুদের মোসলমান কাটার কথা, অন্যদিকে মোসলমানদের হিন্দু কাটার গল্প।
ভাবছি, কলকাতায় তখন দিন কেমন রাত কেমন কে জানে! ওই যে গলির মোড়ে একজন দাঁড়িয়ে, লোকটা লুঙ্গি আর হাফ শার্ট পরে আছে। লক্ষ্মীদার মত ধুতিপরা একজন লোক উল্টো দিকে গলি থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো। লুঙ্গি পরা লোকটা হাতছানি দিয়ে কাকে যেন ডাকলো। তিন-চারজন তার পাশে এসে দাঁড়ালো। তারপর রাস্তা পার হলো। ওদিকে ধুতিপরা লোকটার চোখ যেন ভয়ের চোটে ফেটে বেরিয়ে আসবে। তার পেটে যখন ছুরি ঢুকলো, কেমন খ্যাঁস করে একটা শব্দ হলো! লোকটা কোনো শব্দ করলো না। শুধু আলগোছে শুয়ে পড়লো।
আবার যেন দেখছি, গলির পর গলি- কী সরু সরু গলি! দু’দিকে সার বাঁধা তিনতলা চারতলা বাড়ি। মালকোচা মারা একটা লোক পাঁঠাকাটা দা হাতে একটা বাড়িতে ঢুকলো। কোনদিক থেকে হাজির হলো কখন আরো দশ-বারোজন। ঘরের ভেতর একজন নামাজ পড়ছিলো, একটা বাচ্চা মেয়ে হাতে মেহেদি দিয়ে বসে ছিলো। একটু পরে বাড়ির ভেতর শান বাঁধানো উঠোনে ফেনা আর বুদবুদ মেশা রক্ত ছুটে যাচ্ছে।
তখন পাড়ায় পাড়ায় এসব গল্প ছুটে বেড়াতো। যারা বলছে, তারা কি দেখে এসেছে এসব ঘটনা! কাউকে বোঝানো যাচ্ছে না যে, এসব বলো না। এসব কথা ছড়িও না। কারো কথায় তখন হিংসা তো কারো চোখে হিংসা। রক্তের স্রোত এইসব হিংসা-প্রতিহিংসার আগুন নেভাতে পারছে না। মানুষ যে কী ভয়, বুকের ভেতর চাপা আতঙ্ক নিয়ে বাস করছে- কখন না কাটা পড়তে হয়! আতঙ্কে হাজার হাজার মানুষ বাড়ি-ঘর ফেলে পালিয়ে গেছে। আর কোনোদিন হয়তো ফেরা হয়নি। কেউ হয়তো ফিরেও আর নিজের ভিটেমাটি ফিরে পায়নি। উদ্বাস্তু হয়ে গেছে। মানুষ হয়ে মানুষকে তাড়িয়ে দিয়েছে নিজ বাড়ি থেকে। সাতচল্লিশে, একাত্তরে একইভাবে মানুষকে প্রাণের ভয়ে বাড়ি-ঘর ফেলে পালাতে হয়েছে। তারপর দেশ তো স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু সেই আতঙ্ক যেন আবার ফিরে ফিরে আসে।