হাজার বছরের পথচলায় আজও বহমান নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন। নারীনেত্রী ও মানবাধিকারকর্মীদের মতে, নারীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। তবে সুযোগ ও অধিকারের বৈষম্যও বড়। দেশে এখনও নারীর আয় পুরুষের তুলনায় কম। সমতার চ্যালেঞ্জও সবখানে। নারীর উন্নয়নের প্রশ্নে দেশ অনেকটা এগিয়ে গেলেও সমতার প্রশ্নে এখনও আশাতীত সফলতা নেই। সংশ্নিষ্টদের মতে, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে দূর করতে হবে নারী-পুরুষ বৈষম্য। পুরুষতন্ত্রকে উৎপাটন করতে হবে সমূলে।

বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমতার কথা উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, ‘সংবিধানের সর্বক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমতার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা ঘটে না। প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী ঘরে-বাইরে বিভিন্ন বৈষম্য-পার্থক্য-প্রভেদ-অসমতার শিকার হয়। ধর্মীয় আইনের অপব্যবহারের কারণেও তারা বৈষম্যের শিকার হয়।’ তিনি বলেন, সমাজে সমতা নেই বলেই দিন দিন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়ছে।

চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের এক নারী ওয়ার্ড নিকাহ রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়ার আবেদন করলে রিট খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। জানা যায়, ২০১৪ সালে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়িয়া পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে তিনজন নারীর নাম প্রস্তাব করে তিন সদস্যের প্যানেল। পরে তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ২০১৪ সালের ১৬ জুন আইন মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়’ মর্মে চিঠি দিয়ে তিন সদস্যের প্যানেল বাতিল করে। পরে আইন মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন নিকাহ রেজিস্ট্রারের প্যানেলে এক নম্বর ক্রমিকে থাকা আয়েশা সিদ্দিকা। রিটের শুনানি নিয়ে আদালত আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠি কেন বাতিল করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট রিট আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয় মর্মে অভিমত দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, ‘পুথিগতভাবে নারীর মর্যাদা ও সমতার কথা বলা হলেও সামাজিকভাবে তা দৃশ্যমান নয়। এ কারণেই ওই নারীর আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। এ ঘটনাও নারী-পুরুষ বৈষম্যের অন্যতম একটি উদাহরণ।’

এদিকে নারী নেত্রীরা মনে করছেন, উচ্চতর শিক্ষা ও দক্ষতা, মানসম্মত জীবিকার সুযোগ, আয় ও সম্পদ, রাজনৈতিক ক্ষমতা, খেলাধুলাসহ নানা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানোই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের অর্জনগুলো বিশ্বে স্বীকৃত। বিশ্বে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বিষয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছিল শীর্ষে। সে বছর বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ৪৮তম। ২০১৭ সালের তুলনায় এটা ছিল ২৮ ধাপ অগ্রগতি। প্রতিবেদনটি বলছে, এমনটা সম্ভব হয়েছে অর্থনৈতিক সুবিধা এবং অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কারণে।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এবং জঁ দ্রজ তাদের ‘ভারত :উন্নয়ন ও বঞ্চনা’ (২০১৫ সালে প্রকাশিত) বইয়ে লিখেছেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতি অনেক বেশি। বাংলাদেশে ৫৭ শতাংশ নারী কর্মজীবী। ভারতে এ হার ২৯ শতাংশ। তারা দেখিয়েছেন, নারীর সাক্ষরতা ও শিক্ষাতেও বাংলাদেশ এগিয়ে। এই দুই অর্থনীতিবিদের কথা, দুনিয়াজুড়ে এ সত্য এখন সুপ্রতিষ্ঠিত।

তারপরও সমতার প্রশ্নে অনড় দেশের নারী নেতৃবৃন্দ ও মানবাধিকারকর্মীরা। মনোবিজ্ঞানী ও লেখক ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘নারী বিভিন্ন দিক দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তারপরও নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত হয়নি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২০ সাল নাগাদ উচ্চপর্যায়ের শিক্ষায় নারী-পুরুষের অনুপাত সমান করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তবে তা অর্জন করা সম্ভব। মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া কমাতে হবে। উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে যাতে যেতে পারে সে পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’

প্রযুক্তিগত কাজে নারীর চেয়ে পুরুষ অনেক বেশি নিয়োজিত। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাময়িকী বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষায় একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে কারিগরি পেশায় নিয়োজিত ১ হাজার ৪৬৯ জনের তিন-চতুর্থাংশের বেশিই পুরুষ। তার ওপর নারীর আয় এখনও পুরুষের তুলনায় কম।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘অন্য অনেক ক্ষেত্রে নারী এগিয়ে গেলেও সমতার প্রশ্নে দেশে এখনও অনেক পিছিয়ে। সম্পদ-সম্পত্তিতেও নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা জরুরি।’

জানা যায়, নারী অধিকার রক্ষা এবং নির্যাতন রোধে সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর, গঠিত হয়েছে কমিটি। কাজ করছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কিন্তু শত কর্মপ্রচেষ্টা সত্ত্বেও সমাজে এখনও নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিত হয়নি। বন্ধ করা যায়নি নারী নির্যাতন।

কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি নাসিমা আক্তার জলি বলেন, ‘দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী দারিদ্র্য এবং নারীর আয়মূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণহীনতা। নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস, যৌতুক, বাল্যবিয়ে, নারীর নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা লালনও এর পেছনে কাজ করে। নারীর মন থেকে এ ধরনের মনোভাব যতদিন পরিবর্তন করা না যাবে, ততদিন সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।’

মেরি স্টোপসের অ্যাডভোকেসি ও কমিউনিকেশন ম্যানেজার এবং জেন্ডার বিশেষজ্ঞ মঞ্জুন নাহার বলেন, ‘সাধারণ নারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নারীর সমতা প্রতিষ্ঠার দিকেই নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি দিতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে নারীর অবস্থান যেন আরও দৃশ্যমান হয়, সেদিকে জোর দিতে হবে। সরকারকে বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে সমতা অর্জন করা প্রসঙ্গে আইনজীবী সালমা আলী বলেন, ‘ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে সব জায়গায় নারীর জন্য এ সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সিডও সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সমতা যদি অর্ধেকাংশে নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে আইনের বাস্তবায়ন জরুরি। পারিবারিক কাঠামোতেও নারীর সমতা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।’