অনলাইন ডেস্ক : বিশ্বকাপের ২১তম আসর বসতে যাচ্ছে রাশিয়ায়। আর মাত্র ১০ দিন পর নতুন আসরের পর্দা। প্রতিটি আসরেই কেউ না কেউ মহাতারকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন। কেউ কেউ কিংবদন্তির পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন। কালজয়ী এসব প্রতিভার কয়েকজনের সামান্য পরিচিতি এখানে তুলে ধরা হলো-
পেলে :
‘কালো মানিক’, ‘ফুটবলের ঈশ্বর’ যে নামেই ডাকা হোক না কেন, পেলে মানে দাঁড়ায় এক বিশ্বজয়ী এক সুপারস্টার, রেকর্ড সৃষ্টিকারী ফুটবল আইকন। যে কোনো খেলাতেই সাধারণ মানবীয় পারফরমেন্সকে ছাড়িয়ে যান অনেক তারকা খেলোয়াড়। সাধারণ খেলোয়াড়ের চেয়ে এইসব তারকা খেলোয়াড় যতটুকু ব্যবধান রচনা করেন, পেলে নিজের সাথে সেইসব তারকাদের মধ্যে তার চেয়েও বেশি ব্যবধান গড়েছিলেন। তিনটি বিশ্বকাপ জয়ী এই ফুটবলারের অর্জন অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে, সবার উর্ধ্বে। পেলে ছিলেন অসামান্য এক প্রতিভা, যিনি প্রতিনিয়তই ফুটবলের নতুন নতুন আবিষ্কারে সবাইকে মোহিত করেছেন। বলের প্রতিটি শট, প্রতিটি পাস, প্রতিটি ড্রিবলিং পেলে ফ্যানদেরকে এমন কিছু উপহার দিয়েছেন যা ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। এমনকি তিনি নিজেও পরবর্তীতে সেই ধরনের শট বা পাসের পুনরাবৃত্তি করেননি। গোলের সামনে সাবলীল ঘাতক, নিখুঁত নিখুঁত পাস, কিংবদন্তির ড্রিবলিং দক্ষতায় পেলে ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ ফুটবলার। তার বিদ্যুৎ গতি এবং বলের উপর তার শক্তির জন্যও তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। ফলে অনেকেই মনে করেন, ফুটবল খেলাটির আবিষ্কার ঘটেছে পেলের জন্যই।
ম্যারাডোনা :
বিশ্বে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার কে? এই প্রশ্নের জবাবে মাত্র দু’জন খেলোয়াড়ের নাম উচ্চারিত হবে। একজন ব্রাজিলের পেলে, অন্যজন দিয়াগো ম্যারাডোনা। এদের মধ্যে আবার কে সেরা, তা নিয়েও বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু একক খেলোয়াড় হিসেবে ম্যারাডোনা যে ইতিহাস রচনা করে গেছেন, তা অন্য কারো পক্ষেই অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। মাত্র একজন খেলোয়াড় সাদামাটা একটি দল নিয়ে বিশ্বে যে ত্রাসের সৃষ্টি করেছেন, প্রতিষ্ঠিত সবার বিরুদ্ধে যেভাবে লড়েছেন, ইতিহাসে তার আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। এ কারণেই তিনি যখন পেলেকে পর্যন্ত হারিয়ে শতাব্দীর সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাতে কেউ অবাক হয়নি। বরং এটাই সঠিক বলে বলা গ্রহণ করা হয়েছিল। তার প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে আরেক ফ্রান্সের গ্রেট মিচেল প্লাতিটি তার সম্পর্কে বলেছিলেন, আমি ফুটবল নিয়ে যা করতে পারি, সে করতে পারে কমলালেবু নিয়ে।’
ম্যারাডোনা ছিলেন একইসাথে জিনিয়াস ও দেবতা এবং সেইসাথে বিপথগামী এক অপদেবতা। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮ হাজার ফুট উপরে মেক্সিকো সিটির আজটেক স্টেডিয়ামে পিটার শিলিটনের (ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক) সাথে লাফিয়ে অতি আলোচিত “ঈশ্বরের হাতের” গোল করেন, তখন তিনি ছিলেন সত্যের খুবই কাছাকাছি। কিন্তু যারা দেবত্বের খুব কাছাকাছি গিয়ে পদস্খলনের শিকার হন, ম্যারাডোনা তারই একটি উদাহরণ। একারণে সবার কাছে অনুসরণীয় হতে পারেননি তিনি। আবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে তিনি যখন বিশ্বকে মাতাতে থাকেন, তখন তারও তুলনা ছিল না।
প্লাতিনি :
তিনি কখনো কোনো ফুটবলারের চূড়ান্ত পুরস্কার বিশ্বকাপ ফুটবল শিরোপা জয় করতে পারেননি। অবশ্য মিচেল প্লাতিনির জাঁকজমক ট্রফি ক্যাবিনেটে শুধু এই ট্রফিটিই অনুপস্থিত। কিন্তু তবুও একজন ফুটবল কিংবদন্তি হিসেবে তার অবস্থান থেকে তাকে সরানো যাবে না। তার টেকনিক্যাল সামর্থ্য, চমৎকার ভারসাম্য, খেলার প্রকৃতি অনুধাবন সক্ষমতা এবং গোলের সামনে তার শৈল্পিক চাতুর্য তাকে ফুটবলের সর্বকালের সেরা তারকাদের একজনের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। বিশ্বকাপ জয় না করার অতৃপ্তি তার আছে, কিন্তু অন্যসব প্রাপ্তি তাকে বিশ্বফুটবলে সম্মানজনক আসন এনে দিয়েছে। এসব ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভার ঊর্ধ্বে ফরাসি জাতীয় ফুটবল দলের উদ্দীপ্ত অধিনায়ক হিসেবেও তার দক্ষতা, নৈপূণ্য ভুলবার নয়। তিনি টানা তিনবার-১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৫-ইউরোপিয়ান বর্ষসেরা ফুটবলার (ব্যালন ডি’য়র) হয়ে আরেকটি রেকর্ড গড়েন।
গারিঞ্চা :
যদি বলা হয়, গারিঞ্চার মতো ফুটবলার আগে কখনো ছিল না এবং ভবিষ্যতেও কখনো হবে না, তবে তা অত্যুক্তি হবে না। আনপ্রেডিকটেবল, ম্যাজিক্যাল, দুরন্ত ইত্যাদি বিশেষণ প্রায়ই ব্রাজিলের এই ভালোবাসার মানুষটির নামের সাথে বসানো হতো। ব্রাজিলের এক কবি তো তাকে ‘বাঁকানো পাখার দেবদূত’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন। প্রকৃতির এক শিশু, প্রকৃতির এক শক্তি হিসেবে তিনি খেলেছেন। অবশ্য একই সাথে তিনি নিজের জীবনে এবং ফুটবলে ছিলেন পুরোপুরি বিশৃঙ্খল। কিন্তু তারপরও ব্রাজিল এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠতম যে কজন ফুটবলারের জন্ম দিয়েছে, তাদের অন্যতম এই গারিঞ্চা। দুই দুটি বিশ্বকাপের নায়ক-১৯৫৮ সালে সুইডেনে এবং ১৯৬২ সালে চিলিতে, তিনিই ছিলেন জয়ের কারিগর। তবে গারিঞ্চা দুর্ভাগ্যজনকভাবে আরেক মহানায়ক পেলের ছায়ায় থাকেন। পেলে যে স্বীকৃতি পেয়েছেন, তার অর্ধেকও জোটেনি তার ভাগ্যে। অথচ গারিঞ্চা না থাকলে পেলের পেলে হয়ে উঠা সম্ভব ছিল কিনা তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। ব্রাজিলিয়ানরা যদি পেলেকে কৌশলগতভাবে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, তবে গারিঞ্চাকে স্মরণ করা হবে তার খেয়ালি কর্মকাণ্ড এবং উদ্ভাবনকুশলতার জন্য। দুর্দান্ত, উদ্দীপ্ত এবং আনন্দদায়ক নৈপূণ্যের মাধ্যমে তিনি সারা বিশ্বের দর্শকদের মধ্যে হাসি ফুটিয়েছেন। ছোট্ট পাখিটির ‘বানানা শট’ আর ড্রিবলিং ছিল অসাধারণ। বলের উপর নিয়ন্ত্রণও ছিল অপরিসীম।
দিনো জফ :
একটি পাহাড়, একজন কর্মনিষ্ঠ, একজন নিখুঁতকর্মী: বিশ্বে সর্বকালের সেরা গোলরক্ষকদের একজন হিসেবে দিনো জফ অভিহিত করা যায়। তার সম্পর্কিত কিছু তথ্য হলো: তিনি তিনবার বিশ্বকাপ খেলে ১৯৮২ সালে একবার জিতেছেন, জাতীয় দলের হয়ে ১১২টি আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ খেলেছেন এবং ১,১৪২ মিনিট কোন গোল হজম না করার রেকর্ড গড়ছেন। ১৯৮২ সালে ৪০ বছর বয়সে তিনি বিশ্বকাপ জয় করার মাধ্যমে সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় হিসেবে সর্বোচ্চ সাফল্যের রেকর্ড গড়েন। প্রতিটি মুহূর্ত তিনি যে পরিশ্রম করেছিলেন, তার ফল তিনি পেয়েছিলেন ভালভাবেই।
লেভ ইয়াসিন :
রাশিয়ার লেভ ইয়াসিনকে বিবেচনা করা হয় বিশ্বের সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক। এক গরিব পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি সেরাদের মধ্যে নিজের অবস্থান করে নিতে পেরেছেন। খেলার মাঠে ইয়াসিনের পজিশন জ্ঞান ছিল অসাধারণ। বল কখন কোন দিক থেকে আসবে তা আগেই বুঝে নিতে পারতেন ইয়াসিন। মস্কো ডায়নামোর কোচ বেদকভের মতে, ইয়াসিন পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণ করতেন গোটা মাঠ। কোনো খেলোয়াড় হতাশ কিংবা শ্লথগতি হয়ে পড়লে ইয়াসিন তাকে সাহস যোগাতেন। উৎসাহ দিতেন। নিজের জীবনের উদাহরণ টেনে সজীব করে তুলতেন। নিজে খেলতেন, অপরকেও সাহায্য করতেন খেলতে, এই ছিল ইয়াসিনের বৈশিষ্ট্য।
লেভ ইয়াসিন সোভিয়েত রাশিয়া দলের হয়ে ১৯৫৮, ১৯৬২ এবং ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপের খেলায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে সেরা গোলরক্ষকের সম্মান অর্জন করেন ইয়াসিন।
ইউসেবিও :
কখনো দি ব্ল্যাক পার্ল আবার কখনো দি ব্ল্যাক প্যান্থার হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। আফ্রিকার মোজাম্বিকে জন্মগ্রহণ করা এই কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার পর্তুগালের কিংবদন্তি হিসেবেই ফুটবল দুনিয়ায় পরিচিত। সেই সাথে ইউসেবিও ডা সিলভা ফেরেইরার বদলে শুধুমাত্র ইউসেবিও নামেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৬০ এর দশকের প্রায় পুরোটা এবং ১৯৭০ এর দশকের প্রথমার্ধে তিনি ছিলেন সমসাময়িক বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম তারকা এবং সর্বকালের সংক্ষিপ্ততম তালিকায় স্থান পাওয়া এক খেলোয়াড়। পেলে, পুসকাসের সময়েই স্বকীয়তা ফুটিয়ে তুলতে পারা কম কথা ছিল না। তার গতি, দ্রুত ড্রিবলিং এবং প্রচণ্ড শক্তিতে নিখুঁত ডানপায়ে শটের জন্য বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এই ইনসাইড ফরোয়ার্ডের বল নিয়ে খেলার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা দর্শকরা মোহিত হয়ে যেত। নিরীহ প্রকৃতির মানুষটি কোনো কারণে মেজাজ হারালেও কখনো কঠোর মনে হতো না। রাজকীয় ভঙ্গিতে ছিল তার বল নিয়ে চলাফেরা। প্রতিটি শট ছিল যেন পারমাণবিক শক্তি চালিত ক্ষেপণাস্ত্র।
রজার মিলা :
বুড়ো বয়সটা এমনই সময় যখন তুমি বলতে পারো, “আমি এতো তারুণ্য আর কখনো অনুভব করিনি” এই প্রবচনটি রজার মিলা সম্পর্কেই লিখা হয়েছিল বলে মনে করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে বৈকি। ক্যামেরুনের এই স্ট্রাইকারটি আফ্রিকান ফুটবলের প্রতিকৃতি হিসেবে ৩৮ বছর বয়সের মতো বৃদ্ধকালে আন্তর্জাতিক ফুটবলের রঙ্গমঞ্চে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। দারুণ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে চমৎকার টেকনিশিয়ান হিসেবে রজার মিলা নামের ফুটবলারটি বাস্তবিকই প্রায় একাই ক্যামেরুনকে ১৯৯০ সালে ইটালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন। অবিশ্বাস্যভাবে তিনি চার বছর পরে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপেও খেলেছিলেন এবং গোলও করেছিলেন। যে বয়সে খেলোয়াড়রা সাধারণত খেলা ছেড়ে দেন, সেই বয়সেই তিনি সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছেন এবং আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে তিনি ছিলেন প্রথম আফ্রিকান তারকা।
রোমারিও :
বিশ্ব ফুটবলের ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলারের সংখ্যা কম নয়। রোমারিও সেইসব কিংবদন্তিদেরই একজন। আন্তর্জাতিক ম্যাচে অর্ধ শতাধিক গোল করেছেন এমন ফুটবলারদের অন্যতম তিনি। তিনি নিজে দাবি করেন, পেলের পর তিনিই ব্রাজিলের সেরা ফুটবলার। তার দাবি নিয়ে অনেকের সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু পেশাদার ফুটবলের ইতিহাসে তিনিই পেলের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক গোল (ফিফার হিসাব অনুযায়ী সাড়ে নয় শত, তার নিজের মতে সংখ্যাটি হাজার পেরিয়ে গেছে, সহস্র গোল একমাত্র পেলেই করেছেন) করে নিজের দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন। তাছাড়া বিশ্বের অন্যতম কঠিন ক্লাব লিগ হিসেবে পরিচিত ব্রাজিলিয়ান লিগে তিনি দ্বিতীয় সর্বাধিক গোলদাতা এবং ছয়বার শীর্ষ গোলদাতা হয়েছেন। এমনকি তিনি জাতীয় দলের হয়ে শেষ ম্যাচেও গোল করেছেন। ফলে ফুটবলের ইতিহাসে এই ফরোয়ার্ডের স্থান একজন মহান তারকা হিসেবেই টিকে থাকবে তা আনায়াসেই বলা যায়। তাছাড়া পেলের পর ব্রাজিলকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় আসীন করার ক্ষেত্রেও তার অবদান অনস্বীকার্য। পেলে বিদায় নেওয়ার পর সক্রেটিস, জিকোর মতো কিংবদন্তির ফুটবলারদের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও বিশ্বকাপ জয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল ব্রাজিল। রোমারিওই সেই খরার অবসান ঘটান ১৯৯৪ সালে।