দু’হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো – সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত।
বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় ১৫তম স্থানে কোন একজন ব্যক্তির নাম আসেনি। বলা যেতে পারে এসেছিল একটি চেতনার নাম। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, এঁদের একযোগে ‘ভাষা শহীদ’ হিসাবে মনোনীত করেছিলেন অসংখ্য শ্রোতা।
বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা শহীদদের অবদান কতটুকু সেটা হয়ত আজ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম দেখলেই বোঝা যায়।
একটি স্ফুলিঙ্গ যেমন একটি দাবানল সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের ওপর পুলিশের গুলির্ষণ থেকে ১৯৫২ সালে সৃষ্টি হয়েছিল একটি দাবানল।
উনিশশ সাতচল্লিশ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হবার পর ৪৮য়ে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করেছিল যে, ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়। দানা বেঁধে ওঠে বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে এক জনসভায় ঊর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করার পর সেই আন্দোলন আরও গতি পায়।
বিবিসি জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি: ১৬-মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
বিবিসি জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি: ১৭ নম্বরে বিবেকানন্দ
বিবিসি জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি: ১৮নম্বরে অতীশ দীপঙ্কর
বিবিসি জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি: ১৯ নম্বরে জিয়াউর রহমান
বিবিসির জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি: ২০তম স্থানে সোহরাওয়ার্দী
আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি ক’রে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দশজন দশজন করে স্লোগান দিতে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পেরিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মিছিল এগোতে থাকে অ্যাসেম্বলি ভবনের দিকে। শুরু হয় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস। কিন্তু পুলিশ পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়। ফলে গুলি চলে।
এর পরের কথা বলেছিলেন চারুশিল্পী মুর্তজা বশীর, যিনি সেদিনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
“হঠাৎ গুলি চলা শুরু হলো। গুলি চলার পর আমরা দেখলাম একটা জটলা এগিয়ে আসছে। পিঁপড়ে যেমন করে আসে, ওইরকম। তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম। দেখলাম একটি ছেলে – পেটের নিচ দিয়ে রক্ত পড়ছে- কল খুললে যেমন পানি পড়ে – ওভাবে। সে বলল, আমার বাড়িতে খবর দেবেন। আমার নাম আবুল বরকত।”
মি. বশীর হাসপাতালে পৌঁছে দেখেছিলেন আরও লাশ।
“ওকে নিয়ে যখন আমরা মেডিকেল কলেজে গেলাম, সেখানে ওকে রাখার পর আরেকটা লাশ দেখলাম, যার মাথার খুলিটা নেই। আরেকজনের লাশ আসল, যার পায়ের গোড়াটা ফাটা বাঁশের মত ফেটে ফাঁক হয়ে রয়েছে। পরে শুনেছিলাম মাথার মগজ বেরিয়ে গেছে যার, তার নাম রফিক আর দ্বিতীয়জন জব্বার।”
ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের শেষ পর্বের ছাত্র বরকত ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পাশ করেন।
রফিকউদ্দিন ছিলেন মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের আই.কমের ছাত্র। আরেকটি নাম ছিল জব্বার। ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার পাঁচুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জব্বার।
শফিউর রহমান ঢাকার হাইকোর্টে হিসাব-রক্ষণ শাখায় চাকরি করতেন। ২২শে ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকার নবাবপুর রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে সন্ধ্যে সাতটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
আব্দুস সালাম ছিলেন নোয়াখালি জেলার ফেনী মহকুমার লক্ষ্মণপুর গ্রামের সালাম ঢাকায় এসেছিলেন চাকরির সূত্রে। সরকারি অফিসে পিওন ছিলেন তিনি। থাকতেন নীলক্ষেত ব্যারাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে তিনটেয় মেডিকেল কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ই এপ্রিল মারা যান।
ছাব্বিশ বছরের এক সুঠাম যুবক আব্দুল আওয়াল ২২শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হন। রিক্সাচালক আব্দুল আওয়াল বাবা, মা, স্ত্রী এবং ছয় বছরের কন্যার সাথে বাস করতেন ঢাকার হাফিজুল্লাহ রোডে।
ওহিউল্লাহর বয়স ছিল মাত্র আট কিংবা নয়। সম্ভবত কনিষ্ঠতম ভাষা শহীদ। ২২ তারিখে নবাবপুর রোডের খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বুলেট রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের শিশুপুত্র ওহিউল্লার মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল। তার লাশটাও গুম করে ফেলা হয়েছিল।
ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন সেটা যেন ছিল মৃত্যুর প্রতিযোগিতা।
“কে জীবন দেবে? তখন তো জীবন দেওয়ার প্রতিযোগিতা। এরা প্রাণ দিয়েছিল। এবং সেই প্রাণ দেওয়ার যে ইমপ্যাক্ট হয়েছিল, সেটা আমরা পরে বুঝতে পেরেছিলাম। বুঝেছিলাম মানুষের এতে বিরাট সমর্থন আছে।
”আমরা মিছিল বের করলাম। মিছিলের ওপর গুলি হল, মিছিল ছত্রভঙ্গ হল। আবার সমবেত হল। মিছিল আবার এগলো। এগোতে এগোতে শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার দিকে দেখা গেল লাখ খানেক লোক সমবেত হয়েছে। সেটাই তখন অভ্যুত্থানে পরিণত হল,” বলেছিলেন আব্দুল মতিন।
“এরা যদি আত্মাহুতি না দিতো, তাহলে এই অভ্যুত্থান হতে পারতো না।”
এ ঘটনার অভিঘাতে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। ২২ ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করেছিল এবং সভা ও মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিল।
ভাষা শহীদদের আত্মদানের স্ফুলিঙ্গ থেকে যে দাবানল জ্বলে উঠছিল, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে গণআন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল, তার কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার।
ফলে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে সেখানে বাংলা ও ঊর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে এই দাবানলই একে একে দেশটির স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল।
ওই ভাষা আন্দোলনে যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন, তারা এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।