“আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে কী হচ্ছিলো। যখন ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করলাম তারা বললো সবকিছু ঠিক আছে।”
বলছেন ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার ২০ বছর বয়সী এক মেডিকেলের ছাত্রী।
ভারতে যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যেই তিনিই প্রথম আক্রান্ত হন।
ধরা যাক তার নাম রাফিয়া। (নিরাপত্তার কারণে তার নামটি গোপন রাখা হলো) বিবিসির কাছে তিনি বলেছেন তার বেঁচে যাওয়ার গল্প।
আরো চারজনসহ তাকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
“তবে তখনও আমার পরীক্ষার ফল জানানো হয়নি। কেউ আমাকে কিছু বলছিলো না।”
তাকে হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। সেখানে তিনি ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করছিলেন টেস্টের ফলাফলের জন্য। সেসময় হঠাৎ করেই তার ফোনে একটি বার্তা এলো।
“আমার এক বন্ধু টেলিভিশন থেকে খবরটি নিয়ে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালো।”
ওই খবরটি ছিল চীনের উহান শহর থেকে আগত মেডিকেলের এক শিক্ষার্থীর ওপর, যার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় দেখা গেছে যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।
রাফিয়া তখন খুব সহজেই বুঝতে পারলেন টিভির ওই রিপোর্টে আসলে তার কথাই বলা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমি যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছি সেটা আমি টিভির ওই সংবাদ থেকেই জানতে পারলাম।”
সরকারিভাবে ৩০শে জানুয়ারি জানানো হলো যে তিনি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ভারতে তিনিই প্রথম করোনাভাইরাস রোগী।
এক ঘণ্টার মধ্যেই তার কাছে ডাক্তার চলে এলো। তারা তাকে পরীক্ষার ফলাফল জানালেন। চিকিৎসার জন্যে তাকে আরো দীর্ঘ সময় হাসপাতালে রেখে দেওয়া হলো।
তিনি বলেন, টেস্টের রেজাল্ট জানার পর তিনি মোটেও ভীত হননি।
“আমি তো ভালোই ছিলাম। সেসময় আরো অনেকেরই তো সফল চিকিৎসা চলছিলো।”
“আমি জানতাম এই ভাইরাসটিতে বয়স্ক লোকজন আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে যাদের শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা আছে তারা। আমি নিজেকে শান্ত রেখেছিলাম। চিন্তা ভাবনাও ছিলো ইতিবাচক।”
কর্তৃপক্ষ তখন তাকে নিয়ে বেশ তৎপর হয়ে উঠলো। ২৫শে জানুয়ারি ভারতে ফিরে আসার পর তিনি কার কার সংস্পর্শে এসেছেন তাদের নাম জানতে চাওয়া হলো তার কাছে।
সাথে সাথে এর প্রভাব পড়লো তার পরিবারের ওপর।
ফারিয়ার মাকে থ্রিসুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে আলাদা করে রাখা হলো। এই হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিলো তারও।
কিন্তু তাদের কেউ কাউকে দেখতে পেতেন না। তার পিতা ও এক ভাইকেও তাদের বাড়িতে লোকজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হলো।
রাফিয়া চাইছিলেন তার মাধ্যমে আর কেউ যাতে এই ভাইরাসে আক্রান্ত না হন।
তিনি বলেন, “ভাইরাসের বহনকারী হওয়ার চেয়ে আলাদা থাকাই ভালো।”
ফারিয়াকে স্বাভাবিক খাবার দাবারই দেওয়া হচ্ছিল। তাকে যে ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল সেটি দিনে দুবার ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হতো।
তিনি বলেন, ডাক্তার ও নার্সরা কোন ধরনের ভয়-ভীতি না দেখিয়েই তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন।
“তারা যখন আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে আসতেন তারা নিজেদেরকে রক্ষার জন্যে নানা রকমের জিনিস পরতেন। তারা খুবই ভালো।”
চীনে এই ভাইরাসটি নিয়ে কী হচ্ছিল তার পাশাপাশি এর চিকিৎসাগত দিক নিয়েও তিনি অবহিত ছিলেন।
চীনের উহান শহরে গত তিন বছর ধরে মেডিসিন বিষয়ে পড়ছিলেন রাফিয়া।
“৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত আমাদের ক্লাস ছিল। সেসময় আমাদের সেমিস্টার পরীক্ষা চলছিল। আমরা সবাই কয়েক সপ্তাহের ছুটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
কিন্তু মাসের মাঝামাঝি গিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গেল। একই সাথে ছড়িয়ে পড়ছিল গুজবও।
“২০শে জানুয়ারি আমরা দেখলাম যে এই রোগটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তখন আমরা উহান ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই এবং আমি প্লেনের টিকেট বুক করি।”
ভারতীয়দের উদ্ধার করার জন্যে ভারত সরকার বিমান পাঠানোর আগেই রাফিয়া সেখান থেকে চলে আসেন।
শহরটি পুরোপুরি অবরুদ্ধ ঘোষণা করার আগেই তিনি ওই শহর ছেড়ে আসতে সক্ষম হন।
তিনি প্রথমে কলকাতা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। তার পর সেখান থেকে আরেকটি বিমানে করে আসেন দক্ষিণের কোচিন শহরে।
“কলকাতা বিমানবন্দরে আমি থার্মাল স্ক্রিনিং-এর ভেতর দিয়ে যাই। কোচিন এয়ারপোর্টেও সেটা করা হয়। কিন্তু আমার দেহে ওই ভাইরাস সংক্রমণের কোন উপসর্গই ছিল না।”
করোনাভাইরাস কিভাবে ঠেকাতে পারে ব্যস্ত শহরগুলো
করোনাভাইরাস: বিভ্রান্তিও ছড়াচ্ছে ভাইরাসের মতোই
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তিটি কে?
পরের দিন তিনি বেইজিং-এ ভারতীয় দূতাবাস থেকে একটি বার্তা পান। সেখানে তার মতো আরো যারা চীন থেকে এসেছে তাদের আরো কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার অনুরোধ জানানো হয়।
তিনি তখন সেখানকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। ওই পরীক্ষাতেও উদ্বেগজনক কিছু ধরা পড়েনি।
কিন্তু এর দুদিন পর, ২৭শে জানুয়ারি, গলা ব্যথা নিয়ে তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং বুঝতে পারেন শরীরে হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে।
তখন তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে পরীক্ষায় দেখা যায় যে তিনি ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
রাফিয়াকে ছোট্ট একটি ঘরে আলাদা করে রাখা হয় প্রায় ২০ দিন। ওই ঘরের একটি জানালা দিয়ে তিনি বাইরের দুনিয়াকে দেখতে পেতেন।
“আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে আমার শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা ভাইরাসটিকে মোকাবেলা করবে।”
রাফিয়া এবং তার পরিবারকে এখনও একটি বাড়িতে কোয়ারেন্টিন করে রাখা হয়েছে। আরো কয়েক দিন পর এই অবস্থার শেষ হবে।
“এটা আমার জীবনের একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। আমি নিজেকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম না। বরং আমি আমার পরিবার ও বন্ধুদের নিয়েই চিন্তিত ছিলাম।”
এখনও পর্যন্ত ৫০টিরও বেশি দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। আর সারা বিশ্বে এই ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩,০০০। বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনাই ঘটেছে চীনে।
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি আবার উহানে ফিরে যাবো। সেখানে আমার ছয় বছরের কোর্স সম্পন্ন করবো,” বলেন রাফিয়া।
রাফিয়া বলেছেন, মেডিকেলের একজন ছাত্রী হিসেবে এই ঘটনা থেকে তিনি অনেক বড় শিক্ষা নিয়েছেন।
“আমি যখন ডাক্তার হবো আমি সবার আগে রোগীকে তার অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করবো।”