ডাসেস অফ সাসেক্স এবং ডিউক অফ উইন্ডসর

একজন জনপ্রিয়, আমোদপ্রিয় রাজকুমার এক প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মার্কিন নারীর প্রেমে পড়ে যান। যার কিনা আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল, পরে সেটি বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

এই নারী একটি বৈরি ব্রিটিশ গণমাধ্যমের দ্বারা হেয়-প্রতিপন্ন হয়েছিলেন।

হ্যারি এবং মেগানের মধ্যে অষ্টম এডওয়ার্ড এবং ওয়ালিস সিম্পসনের প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়েছেন কয়েকজন রাজকীয় পর্যবেক্ষক।

আট দশক আগে এই দম্পতি রাজ ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া নিয়ে সংকটের কেন্দ্রে ছিলেন।

তবে দুই দম্পতির মধ্যে এ ধরণের তুলনা করা কি চলে?

সাসেক্সের ডিউক এবং ডাচেসকেও যদি উইন্ডসরের ডিউক এবং ডাচেসের মতো বেদনাদায়ক নির্বাসনের মুখে পড়তে হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত হয়তো এই তুলনা করা যাবে।

১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে, রাজা তার সিংহাসন এবং ৫০ কোটি মানুষের একটি সাম্রাজ্য ছেড়ে দিয়েছিলেন যাতে তিনি এমন এক নারীকে বিয়ে করতে পারেন যিনি তার দ্বিতীয় স্বামীকে তালাক দিতে যাচ্ছেন।

তার এই হবু স্ত্রী ওয়ালিস সিম্পসনকে উদ্দেশ্য করে সাধারণ মানুষ অজস্র কটু কথা উগরে দিয়েছিল।

সর্বশেষ এক মার্কিনীর, ব্রিটেনের রাজপরিবারের কাউকে বিয়ে করা এমনই কোন ঘটনার জন্ম দেবে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর শহরের সাধারণ রো হাউজে বেড়ে ওঠা সিম্পসন আগে থেকেই নিন্দিত ছিলেন তার উচ্চভিলাশি জীবন যাপনের জন্য।

তাকে একজন সস্তা হঠকারী নারী, সমকামী, একজন কাম-আসক্ত, নাৎসি গুপ্তচর এবং হিজড়া বলেও গালি দেওয়া হয়েছিল।

তাকে এমন একজন যৌন জাদুকর হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছিল যিনি সম্ভবত সাংহাই-এর পতিতালয়গুলোতে “প্রাচীন চীনা দক্ষতা” শিখেছিলেন।

এই সাংহাইতে কাজ করতেন সিম্পসনের প্রথম স্বামী, যিনি ছিলেন মার্কিন নৌবাহিনীর একজন পাইলট।

তবে সিম্পসনের উপর গণমাধ্যমের এই আক্রমণ কেবল লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।

ডেইলি এক্সপ্রেসের সাংবাদিকরা লন্ডনের রিজেন্টস পার্কে তার ভাড়া করা বাড়ির জানালা দিয়ে ইট ছুড়ে দিয়েছিল।

পত্রিকাটির মালিক লর্ড বিভারব্রুক পরে সেটা স্বীকার করেন।

রাজপরিবার ছাড়ছেন প্রিন্স হ্যারি ও মেগান

উইন্ডসর প্রাসাদে হ্যারি-মেগানের রূপকথার বিয়ে

ছবিতে দেখুন হ্যারি ও মেগানের বিয়ে

অষ্টম এডওয়ার্ডের ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া নিয়ে সঙ্কট যখন জোরালো হয়ে ওঠে, তখন সিম্পসন ফ্রান্সে পালিয়ে যান।

কান শহরের সাংবাদিকরা তাঁকে খুঁজতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

এসব লোলুপ সাংবাদিকদের থেকে বাঁচতে সিম্পসন রীতিমত পালিয়ে বেড়িয়েছেন।

তার নিজস্ব ব্যাখ্যায় তিনি গাড়ির ধাওয়ার মুখে পড়েছিলেন এবং কখনও কখনও তাকে বাথরুমের জানালা দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এসব সাংবাদিকদের থেকে পালিয়েছেন।

‘দ্যাট ওম্যান, লাইফ অফ ওয়ালিস সিম্পসন’ বইয়ের লেখক অ্যান সেবা বলেছেন যে হ্যারি এবং মেগানের রাজকীয় দায়িত্ব থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত সাংবিধানিকভাবে এতোটা কাঁপিয়ে দেয়নি, কারণ সিম্পসনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এবং সাম্রাজ্যকে প্রায় ধ্বংস করার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

সেবা বিবিসিকে বলেন: “আমরা এখন আর ১৯৩৬ সালে বাস করছি না, যখন মানুষ তালাকপ্রাপ্ত নারীদের নিয়ে আতঙ্কিত থাকবে”।

“তারা ভেবেছিল এই ঘটনা সমাজকে একটি অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেবে যেখানে সবাই বিবাহবিচ্ছেদ করবে”।

“তবে আসলেই বড় পার্থক্য হল এডওয়ার্ড রাজা ছিলেন এবং হ্যারি, সিংহাসনের ক্ষমতা নেয়ার সারিতে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছেন – তিনি কখনও রাজা হতে পারবেন না”।

সিম্পসন বস্তাভর্তি মানুষের বিদ্বেষমূলক চিঠি পেয়েছিলেন। যার বেশিরভাগই ছিল ভয়াবহ নারী বিদ্বেষী।

তিনি তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: “আমার নারী পরিচয় নিয়ে এমন হাতে গোনা কয়েকটি গালাগালি ছাড়া বাকি সবই আমাকে শুনতে হয়েছিল”।

তবে এর মধ্যে কিছু কঠিন আক্রমণ হয়েছিল অন্য নারীদের থেকে।

হিউগো ভিকার্সের জীবনী ‘বিহাইন্ড ক্লোজড ডোরস, দ্য ট্র্যাজিক, আনটোল্ড স্টোরি অব ওয়ালিস সিম্পসন’ বইটিতে রানীর একটি মন্তব্য উল্লেখ করা হয়।

রানী বলেছিলেন: “যে দুজন ব্যক্তি আমার দেখা জীবনে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন তারা হলেন ওয়ালিস সিম্পসন এবং হিটলার”।

এমন ঘটনার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন সিম্পসনের শৈশবের বন্ধু মেরি কির্ক।

তিনি তার বান্ধবীর প্রাক্তন দ্বিতীয় স্বামী আর্নেস্ট সিম্পসনকে পরে বিয়ে করেন।

তিনি নিজের একটি ডায়েরিতে তার প্রেমের এই প্রতিদ্বন্দ্বীকে উদ্দেশ্য করে লেখেন: “মানুষ হিটলারকে নিয়ে যেমনটা ভাবে, আমি তাকে ঠিক সেরকম ভাবি। একটি অশনি শক্তি… পশুর ধূর্ততায় পূর্ণ”।

প্রিন্সেস মার্গারেট তার চাচার প্রেমিকাকে “সেই হিংস্র মহিলা” হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন।

জনপ্রিয় আখ্যানটি দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে এডওয়ার্ড – একজন উচ্চাভিলাষী এবং বিলাশবহুল চাহিদাসম্পন্ন নীচ প্রেমিকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন। হ্যারি সম্পর্কেও তাই বলা হয়েছে।

“রাজাকে যে নারী চুরি করেছিল” হিসাবে সিম্পসনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ত সত্ত্বেও, এডওয়ার্ডের কাছে সবসময়ই রাজকীয় দায়িত্ব অসহনীয় বিরক্তিকর বলে মনে হতো।

মেগান এবং হ্যারির মতো তিনিও পালিয়ে গিয়ে কানাডায় থাকার স্বপ্ন দেখতেন।

তার সহকারী একান্ত সচিব অ্যালান টমি ল্যাসেলিস বলেছেন যে, তিনি ১৯২৭ সালে রাজপুত্রের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতার পরে বুঝতে পেরেছিলেন যে ‘শালীনতা’, ‘সততা’, ‘কর্তব্য’, ‘মর্যাদার’ মতো শব্দগুলি তাঁর কাছে একেবারেই কিছুই নয়।

এই রাজকীয় উপদেষ্টা, এডওয়ার্ডকে “একজন ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্ষমতাবান” বলে উপসংহার টেনেছেন।

হ্যারি এবং মেগান যেহেতু একটি নতুন জীবনের পথে হাল ধরেছেন। এতে সন্দেহ নেই যে তারা উইন্ডসর-এর ডিউক এবং ডাচেসের মতো লক্ষ্যহীন অস্তিত্বের পথটি এড়িয়ে চলবেন।

যুদ্ধ চলাকালীন অল্প সময়ের জন্য বাহামার গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব পালন ছাড়া এডওয়ার্ড এবং তাঁর স্ত্রী কেউই আর কখনও কাজ করেননি। অথচ মেগানের বিষয়টি আলাদা।

ব্রিটেনের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী ইতিহাসের অধ্যাপক অলিভেট ওটেল উল্লেখ করেছেন যে মেগান একজন সফল অভিনেত্রী, কর্মী এবং লাইফস্টাইল ব্লগার। সিম্পসনের জীবনে কখনও চাকরিই হয়নি।

ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বলেন, “একজন ছিলেন সোশ্যালাইট,” অর্থাৎ সামাজিক আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত এবং অপরজন স্বাধীন ও সফল নারী যিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য নিজের আয়ের উপর নির্ভর করেছেন।”

প্রফেসর অটেল বলেছেন যে, ডাচেস অব সাসেক্সের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নানা বর্ণবাদী আক্রমণ চালানো হয়েছে। কারণ তিনি মিশ্র জাতির।

এ কারণে এই দু’জনকে একই রেখার মধ্যে ফেলা “সম্পূর্ণ নির্বোধের” মতো কাজ।

“ওয়ালিস সিম্পসনের সঙ্গে ব্রিটিশ গণমাধ্যম অবশ্যই অনেক খারাপ ব্যবহার করেছিল,” প্রফেসর ওটেল বলেন, “তবে এটি কখনও মেগানের মতো ছিল না।”

রাজকীয় প্রতীক দ্বারা বেষ্টিত প্রবাসের একটি ছোট বাড়িতে, এডওয়ার্ড এবং ওয়ালিস তাদের ধনী বন্ধুদের থেকে দূরে সরে বাকী জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।

হ্যারি এবং মেগানের মতো, এডওয়ার্ড এবং ওয়ালিসও হলিউডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

ফ্রান্সের ছোট শহরের বাড়িটিতে তারা রিচার্ড বার্টন এবং মারলিন ডায়েট্রিচের মতো চলচ্চিত্র তারকাদের দাওয়াত করেছেন।

গল্ফ খেলা ছাড়া এডওয়ার্ডের আর কিছু করার ছিল না। তিনি তাঁর ১১-মাসের রাজত্ব সম্পর্কে কোনও অনুশোচনা প্রকাশ করেননি, যদিও তাঁর গল্পগুলি প্রায়শই এই শব্দগুলো দিয়ে শুরু হতো: “যখন আমি রাজা ছিলাম …”

প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলি বাল্ডউইন থেকে শুরু করে রানী মায়ের কাছে তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পেছনে তিনি নিজেকে ছাড়া বাকি সবাইকে দোষারোপ করেছেন।

“কুড়ি বছর আমি নিজের দেশের জন্য কাজ করেছি এবং তারা আমাকে আমার পেছনে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে,” বেশ রাগান্বিত হয়ে ডিউক তার এক বন্ধুকে এই কথাটি বলেছিলেন।

সম্ভবত সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল শতাব্দীর এই তথাকথিত রূপকথার প্রেমকে ঘিরে বেশিরভাগ জীবনীবিদ একটি কথাই বলেছেন যে এডওয়ার্ড তার মুকুট এমন এক নারীর জন্য পরিত্যাগ করেছেন যিনি তাকে সত্যিকার অর্থে ভালবাসেননি।

“উইন্ডসরের ডিউক এবং ডাচেজ, সন্ধ্যায় একসাথে তারা হুইস্কি খেতেন। রাতের খাবারের পর সেই হুইস্কি পরিবেশন করা হত এবং তাদের একে অপরকে কিছু বলার ছিল না এ কারণে বোতলের মদের স্তর ধীরে ধীরে নামতে থাকতো”, ব্যক্তিগত সহকারী জন আটার এভাবেই তাদের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন।

অ্যান্ড্রু মর্টনের ‘ওয়ালিস ইন লাভ’ বইটি অনুসারে, সিম্পসনের হৃদয় আসলে তার বন্ধু হারমান রজারের প্রতি দুর্বল ছিল। রজার ছিলেন ধনী এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক।

কথিত আছে যে ডাচেস ১৯৫০ সালে রজার্সের দ্বিতীয় স্ত্রীকে এই অত্যাশ্চর্য স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন, তাও আবার ঠিক তাদের বিয়ের দিনটিতে।

ধীরে ধীরে উইন্ডসরের ডিউক এবং ডাচেজের খ্যাতি বিবর্ণ হতে থাকে। এটাও তাদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

১৯৫৬ সালে ডাচেজের স্মরণে লেখা ‘দ্য হার্ট হ্যাজ ইটজ রিজনস’-বইয়ের প্রকাশক চার্লস পিক বলেছেন যে তিনি তার বইটি নিয়ে আলোচনা করতে যখন প্রথম সিম্পসনের সাথে দেখা করত যান, তখন সিম্পসন তার আরাম কেদারা থেকে উঠে নালিশ করেন যে, তাকে খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে সরিয়ে মেরলিন মোনরোকে জায়গা দেয়া হয়েছে।

১৯৬৬ সালে ডিউক ও ডাচেস ট্রেনে করে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন এবং তারা পাপারাজ্জিদের নিয়ে রাগ ঝাড়তে থাকেন। কারণ তারা আশা করেছিলেন যে পাপারাজ্জিরা হয়তো লুকিয়ে লুকিয়ে তাদেরকে গন্তব্যে খুঁজে বের করবে।

একজন সহায়তাকারী লক্ষ্য করেছেন যে, যখন কোনও ফটোগ্রাফার তাদেরকে ঘিরে ধরেনি তখন তারা তাদের হতাশাকে আড়াল করতে পারেননি।

হ্যারি এবং মেগান এক প্রকার আধা-নির্বাসিত জীবন বেছে নেয়ার কারণে শেক্সপিয়ারের কিছু পরামর্শের কথা মনে রাখা তাদের জন্য ভাল হবে।

চতুর্থ হেনরির, প্রথম খণ্ডে, রাজা তার ছেলে প্রিন্স হ্যারিকে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তিরস্কার করেছেন এবং বলেছেন যে তিনি “বদ্ধ উন্মাদের সাথে তার রাজত্বকে মিশিয়ে ফেলেছেন”।

“এ কারণে আপনি আপনার রাজপুত্র হওয়ার সুযোগ সুবিধা হারিয়েছেন,” রাজা তার উত্তরাধিকারীকে তিরস্কার করেন। “পৃথিবীতে এমন কোন চোখ নেই যা তোমাকে দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে যায়নি”।

করোনাভাইরাস: আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তিটি কে?

প্রথম যে ভারতীয় নারী জিতেছিলেন ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ শিরোপা

ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস, ইটালির কয়েকটি শহর অবরুদ্ধ