মিষ্টির দোকানের কথা মনে হলেই নিশ্চয় আপনার কল্পনায় আসে, কাঁচের বাক্সের ভেতর ট্রেতে থরে থরে সাজানো নানা রকম মিষ্টি। তবে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মিষ্টির দোকানের চিত্রটা এমন ছিল না। তখনকার সময় মিষ্টির দোকানে সিমেন্টে বাধানো প্রায় দুই ফিট উঁচু বেদির ওপর সাদা চাদর পেতে বসে থাকতেন মিষ্টি বিক্রেতা। তাদের পরনে থাকতো ধুতি, গেঞ্জি ও ফতুয়া, গলায় পৈতা, বাহুতে একাধিক মাদুলি এবং একাধিক আঙুলে বিভিন্ন পাথরের আংটি। তারা সাধারণত স্থূলকায় হতেন। রাস্তার দিকে কাসার থালায় সাজানো থাকতো বিভিন্ন রকমের মিষ্টি। রাস্তা থেকেই কাচের ওপাশে দেখা যেতো সাজানো মিষ্টির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কিছু মাছি ও মৌমাছি। প্লেটের পাশে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে কিছু পিঁপড়া। এসব দোকানের স্বাস্থ্যমান ছিল খুবই নিচু মানের।

আলাউদ্দিন সুইটমিটঅতীতে মিষ্টি বিক্রি ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের একচেটিয়া ব্যবসা। মিষ্টি বিক্রেতা ও ময়রা ছিলেন হিন্দু। তাদের মধ্যে ঘোষ উপাধিধারীরা ছিলেন কুলীন। ঘোষ মানেই মনে করা হতো মিষ্টি, দুধ ও দইয়ের ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত।

তবে বাংলায় মিষ্টির এসব চিত্র বদলে দিয়েছিলেন একজন। তিনিই প্রথম শুরু করেছিলেন মুসলিমদের মিষ্টি ব্যবসা। ১৮৯৪ সালে ঢাকার চকবাজারে আলাউদ্দিন প্রথম শুরু করেন তার মিষ্টির ব্যবসা। যা এখন তার চতুর্থ প্রজন্ম চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আলাউদ্দিনের ছেলের নাম আফসারউদ্দিন। আফসারউদ্দিনের চার ছেলের মধ্যে দুজন জীবিত। যাদের মধ্যে হাজি মাহবুবউদ্দিন এখন পরিচালক। আলাউদ্দিন ছিলেন ভারতের লক্ষ্মৌর বাসিন্দা। সত্তরের দশকে, বিশেষত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মিষ্টি ব্যবসার পট দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। এই পট পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা নেয় আলাউদ্দিন সুইটমিট লিমিটেড। গ্রিন রোডে তাদের ব্যবসার সূচনা হয়।

আলাউদ্দিন সুইটমিটআলাউদ্দিনের দোকানে একাধিক ডিসপ্লে শেলফ স্লাইডিং কাচের পার্টিশনে ঘেরা থাকতো। ফলে মাছি-মৌমাছির উৎপাত ছিল কম। দোকানে রেস্টুরেন্টের মতো বেশ কিছু চেয়ার-টেবিল সাজানো হয়। সেখানে ক্রেতারা মিষ্টি দিয়েই সারতেন সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাওয়া। তাদের ভিড়ে দোকান সব সময় গমগম করতো।

এরপরই মোটা খাকি কাগজের প্যাকেট অথবা ঠোঙার বদলে আলাউদ্দিন শুরু করেন তাদের নাম সংবলিত ডিজাইনের পিচবোর্ড বাক্সে মিষ্টি বিক্রি।

এরইমধ্যে সের ও মণ যুগের শেষ হয়ে গিয়েছে। কেজি অথবা পিস দরে মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে। মাপার জন্য ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক স্কেল। মিলাদ, কুলখানি, গায়েহলুদ ও বিয়েতে আলাউদ্দিনের গাঢ় নীল ও ম্যাজেন্টা রঙের বিভিন্ন সাইজের বাক্সে মিষ্টি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু প্যাকেজিং নয়, মিষ্টির বৈচিত্রও আনে আলাউদ্দিন। মিষ্টি প্রেমীদের পরিচয় করাতে থাকে একটার পর একটা নতুন ধরনের মিষ্টির সঙ্গে। এছাড়াও আলাউদ্দিন বাংলায় সেমাই ব্যবসাকে করেছিলেন সমৃদ্ধ।

আলাউদ্দিন সুইটমিট ১৯৮৮ অথবা ১৯৮৯ সালে বিচিত্রা পত্রিকার পুরো একটি পাতাজুড়ে থাকত ভীষণ মজার এক কার্টুন। এই কার্টুনের চরিত্রগুলোর পাশে লেখা থাকত মিষ্টি মিষ্টি নানা কথা। হ্যাঁ এভাবেই পত্রিকায় আলাউদ্দিনের মিষ্টির বিজ্ঞাপন দেয়া হতো। সেসময়টাতে আর কোনো মিষ্টির এমন রসাল বিজ্ঞাপন তেমন দেখাই যেত না।  আলাউদ্দিনের বিজ্ঞাপনের কার্টুন চরিত্র আঁকতেন শিল্পী রফিকুন্নবী।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাঙালিরা বিদেশে চাকরি এবং বসবাসে উৎসাহী হয়। ফলে বাঙালিদের বিদেশে যাতায়াত শুরু হয়ে যায়। বিদেশ যাত্রী বাঙালিরা যাতে বাংলাদেশের ফ্রেশ মিষ্টি নিয়ে যেতে পারে সেই লক্ষ্যে ঢাকা এয়ারপোর্টের কাছে আলাউদ্দিন একটি বড় দোকান খোলেন। আলাউদ্দিনের মিষ্টির মান ছিল স্বাস্থ্যকর এবং সেরা। কোয়ালিটি এবং বৈচিত্র ভালো থাকায় অনেকেই এসব মিষ্টি দেশের বাইরে নিয়ে যেতেন। দেশের বাইরেও আলাউদ্দিনের মিষ্টির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এরপর বিদেশেও তারা তাদের শাখা খোলেন। আলাউদ্দিনের দেশ-বিদেশে ১৬টি শাখা। এর মধ্যে চকবাজার-১, চকবাজার-২, নিউমার্কেট, গ্রিনরোড, মৌচাক, সিদ্ধেশ্বরী, এয়ারপোর্ট, নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস, লন্ডনের ব্রিকলেন অন্যতম।

আলাউদ্দিন সুইটমিট ১১৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী আলাউদ্দিন সুইটমিটের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মিষ্টির মধ্যে রয়েছে- রসগোল্লা, স্পঞ্জ রসগোল্লা, লালমোহন, চমচম, গুড়ের সন্দেশ, কালোজাম, মালাইকারী, মালাইচম, রাজভোগ, দই, হাফসি হালুয়া, দুদিয়া সন্দেশ, কাঁচা সন্দেশ, দই, রসমালাই ইত্যাদি। রোজার সময় চকবাজার শাখায় পাওয়া যায় মন ভোলানো আলাউদ্দিন স্পেশাল জাফরানী সরবত। এছাড়াও রমজানে ইফতারের আয়োজনে আলাউদ্দিনের থাকে কিমা পরোটা, টানা পরোটা, জালি কাবাব, বিফ স্টিক, চিজ লরেন্স, চিকেন স্টিক, চিকেন নাগেট আর পনির সমুচা। এর মধ্যে কিমা পরোটা আর চিস লরেন্সের চাহিদা ব্যাপক।