খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর পরাজয়েও ‘রাজনৈতিকভাবে জয়’ দেখছে বিএনপি। দলের সিনিয়র নেতারা মনে করছেন, ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল ও জাল ভোটের ঘটনায় আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে তাদের ‘নির্দলীয় সরকারে’র দাবির যৌক্তিকতা আরও জোরদার হয়েছে। তবে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর পরাজয়ের নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন খুলনার স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্নেষক ও সুধীমহল। তাদের মতে, খুলনায় বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, কিছু কাউন্সিলর প্রার্থীর প্রতারণা, প্রচার-প্রচারণা কম হওয়া, পুলিশের ধরপাকড় এবং পোলিং এজেন্টরা ‘পালিয়ে যাওয়ায়’ বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন।
একই সঙ্গে জোটের শরিক জামায়াত-শিবিরসহ অন্যান্য ধর্মীয় দল বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে সেভাবে মাঠে না থাকাও পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল সমকালকে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের সহযোগিতায় নির্বাচনে ভোট কারচুপির মাধ্যমে তাদের প্রার্থীর বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ সরকারের অধীনে যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের নির্দলীয় সরকারের দাবির যৌক্তিকতা জোরদার হয়েছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও সরকার একই দায়দায় বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তা কেড়ে নেবে বলে তাদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তবে খুলনা উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি শরীফ শফিকুল হামিদ চন্দন বলেন, বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। অন্য কোনো দলের প্রার্থী বিজয়ী হলে খুলনার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে না বলেই ভোটাররা মনে করেছেন। সে কারণে তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছেন।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সদস্য সেলিম বুলবুল মনে করেন, যে দল ক্ষমতায় থাকে, তার বাইরে অন্য দলের কেউ মেয়র হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেন না। সে কারণে অধিক সংখ্যক ভোটার আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। বিএনপির বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী দলের মেয়র প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করেছেন। দলটির মধ্যে সমন্বয়হীনতাও ছিল প্রকট।
বিএনপি সূত্র জানায়, খুলনা নির্বাচনে ‘অনিয়ম’কে পুঁজি করে জনমত গঠনে কাজ করবে দলটি। এ জন্য তারা অনিয়মের সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। যার মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের দাবির সপক্ষে শক্ত অবস্থান তুলে ধরবেন তারা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সমকাল বলেন, খুসিক নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের মানুষের কাছে বর্তমান সরকারের চরিত্র আরও বেশি পরিস্কার হয়ে গেছে।
দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, খুসিক নির্বাচনে পরাজয়ের কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে তারা দূরে সরে যাবেন না। নেতাকর্মীদের ভোটের মাঠে চাঙ্গা রাখা সম্ভব। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে আগামী প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবে দলটি।
দলের এমন কৌশলের বাইরে নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতাকে নিয়েও কাজ করতে চাইছেন নীতিনির্ধরকারা। ভোটের জন্য যে সাংগঠনিক কাঠামো প্রয়োজন, তা অনেক ক্ষেত্রে নেই দলটির। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এমন চিত্রও উঠে এসেছে বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে। যার কারণে অনেক কেন্দ্রে দলের এজেন্ট হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা।
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়ে উঠেছেন অনেক তৃণমূল নেতাকর্মী। তারা কেন্দ্রের দিকে অভিযোগের তীর ছুড়ে বলেছেন, সরকারের হস্তক্ষেপের পাশাপাশি নিজেদের অক্ষমতার দিকেও তাকান। দ্রুত কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের ওয়ার্ড পর্যন্ত সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শও দিয়েছেন।
তবে বিষয়টি মানতে নারাজ দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান। তিনি বলেন, খুলনা সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন একাকার হয়ে গেছে। এখানে বিএনপি সাংগঠনিক সক্ষমতা প্রমাণ করতে গেলে হতাহত কিংবা বড় কোনো দুর্ঘটনার সৃষ্টি হতো, যা বিএনপি কখনও করে না।
পরাজয়ের নেপথ্যে আরও কারণ :দলীয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা এবং নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান মেয়র মনিরুজ্জামান মনি। দীর্ঘদিন থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তারা সব ধরনের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় নগর বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হন তারা দু’জন। এ জন্য জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে পাল্টা কাউন্সিলর প্রার্থীও ঘোষণা করা হয়। পরে কোন্দল মিটিয়ে তাদের এক টেবিলে আনা হলেও তারা ততটা সক্রিয় ছিলেন না।
এ ছাড়া মহানগর বিএনপির কোষাধ্যক্ষ আরিফুর রহমান মিঠুর সঙ্গে কোন্দল মেটাতে ব্যর্থ হন নজরুল ইসলাম মঞ্জু, যার কারণে খালিশপুর ও দৌলতপুর থানা এলাকায় নির্বাচনী এলাকায় কাজ হয়েছে কম। মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আলী আজগর লবীর অনুসারীদের এবং কোষাধ্যক্ষ আরিফুর রহমান মিঠুসহ দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের ক্ষোভ নিরসন করে সক্রিয়ভাবে মাঠে নামাতে পারেনি বিএনপি। প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে একটি কারণ এটি।
সূত্রটি জানায়, বিএনপির মনোনয়ন ঘোষণা দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী দলীয় মেয়র প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেন। তাদের মধ্যে ৭, ১৭, ১৯, ২০ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থীরা কেউই মেয়র পদের জন্য ভোট চাননি। তাদের অনেকেই গোপনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাফিজুর রহমান হাফিজকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়।
অন্যদিকে, শুরু থেকেই নির্বাচনী প্রচারে পিছিয়ে ছিল বিএনপি। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং বিভিন্ন কেন্দ্রভিত্তিক কমিটিগুলো পৃথকভাবে প্রচার চালিয়েছে। কিন্তু বিএনপিতে এর কোনোটাই হয়নি। প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু একাই সকালে ও বিকেলে প্রচার চালিয়েছেন। বিএনপির অঙ্গ সহযোগী সংগঠন ভোটের মাঠে ততটা সক্রিয় ছিল না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের এক নেতা জানান, নির্বাচনী ব্যয় মেটাতে অর্থ সংকটে নাকাল হতে হয়েছে নির্বাচন পরিচালনা কমিটিকে। পোস্টার লাগানো, হ্যান্ডবিল বা প্রচারপত্র বিলির কাজে যারা জড়িত ছিল, তাদের পর্যাপ্ত টাকা দেওয়া যায়নি। যে কারণে ভোটের আগে নগরীর অনেক এলাকায় বিএনপি প্রার্থীর কোনো পোস্টার দেখা যায়নি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে লিফলেট বিতরণও হয়েছে কম।
জানা গেছে, বিএনপির মিত্র হিসেবে পরিচিত জামায়াত-শিবির এবারের নির্বাচনে পুরোপুরি নিষ্ফ্ক্রিয় ছিল। কাউন্সিলর প্রার্থী নিয়ে বিএনপির সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়।
এ ছাড়া নির্বাচনের আট দিন আগে থেকে শুরু হওয়া ধরপাকড়ের কারণে অনেক নেতাকর্মী খুলনা থেকে পালিয়ে গেছেন। গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আটকের পর ওই দায়িত্ব পালনের মতো আর লোক পাওয়া যায়নি। এমনকি ধরপাকড়ের কারণে পোলিং এজেন্ট ট্রেনিং নিয়েও অনেকে পালিয়ে যান।