গোফরান পলাশ, কলাপাড়া প্রতিনিধি: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্নিঝড় বুলবুল আরও
শক্তি সঞ্চয় করে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা উপকূলের দিকে অগ্রসর হওয়ায় পায়রা
সমুদ্র বন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েমছ। সকাল থেকে
উপকূলীয় এলাকায় হালকা বাতাস সহ ভারি বর্ষন অব্যাহত রয়েছে। শনিবার বিকেল
চারটার দিকে এটি পায়রা বন্দর থেকে ৩১৫ কি.মি. দূরত্বে অবস্থান করায়
ঘূর্নিঝড় আতংকে আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে ছুঁটতে শুরু করেছে সাধারন মানুষ।

এরআগে শনিবার সকালে বঙ্গোপসাগরের খাল গোড়া ও কুয়াকাটার খাঁজুরা এলাকায়
দু’টি ইঞ্জিন চালিত মাছধরা নৌকা ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে ৭ জেলে নিখোঁজ হওয়ার
তথ্য জানিয়েছেন ধূলাসার ইউপি চেয়ারম্যান আ: জলিল আকন। তবে নিখোঁজ
জেলেদের নাম ঠিকানা প্রাথমিক ভাবে জানা যায়নি। এছাড়া কুয়াকাটার ঝাউবাগান
এলাকায় জেল্লাল হোসেন নামের নিখোঁজ জেলের মরদেহ শনিবার বিকেলে ঝাউবাগান
এলাকায় ভেসে আসার খবর জানা গেছে। উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের ভাঙ্গা
বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে নয়াকাটা, চৌধুরী পাড়া, ছোট ৫নং, বড় ৫নং,
মুন্সীপাড়া, বানাতিপাড়া, নেওয়াপাড়া ও চারিপাড়া গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
শনিবার বিকেল থেকে উপকূলীয় এলাকার ঘূর্নিঝড় বুলবুল আতংকে থাকা হাজার
হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আশ্রয় কেন্দ্র গুলোর দিকে ছুঁটতে
শুরু করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে
ব্যাপক প্রচারনা অব্যাহত রেখেছে। মানুষকে নিরাপদ রাখতে কলাপাড়া উপকূলীয়
এলাকায় জিও, এনজিও সহ সিপিপি’র প্রায় আড়াই হাজার নারী-পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক
মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।


দূর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলায় কর্মরত সকল সরকারী কর্মকর্তা
কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। জেলার ৪০৩টি আশ্রয় কেন্দ্র
আশ্রয়প্রার্থী মানুষের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্র
গুলোর তদারকির জন্য একজন করে সরকারী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করা
হয়েছে। জেলার ৮টি উপজেলায় মোট ১০টি কন্ট্রোল রুম খোলায় হয়েছে। বিপদাপন্ন
মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে জেলায় ৭০টি
মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। চিকিৎসা সেবা মনিটরিং করার জন্য খোলা হয়েছে
১টি কন্ট্রোল রুম। নদীপথের অভ্যন্তরীন রুটে সকল ধরনের নৌ যান চলাচল বন্ধ
করেছে বিআইডাব্লিউটিএ। দূর্যোগপূর্ন আবহাওয়ার কারনে উপকূলীয় এলাকায়
মুঠোফোন কোম্পানী গুলোর নেটওয়ার্ক সমস্যা প্রকট আকার ধারন করেছে।

বুলবুল মোকাবেলায় পায়রা বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সতর্কাবস্থানে
রয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বন্দরের সকল কার্যক্রম। নিরাপদে সরিয়ে নেয়া
হয়েছে ট্রাক বোট ও ছোট ছোট জাহাজ। ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে ইন্দোনেশিয়া থেকে
আসা কয়লাবাহি জাহাজ।
এদিকে রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের মধ্য চালিতাবুনিয়া,
বিবির হাওলা ও গরুভাঙা গ্রামের পাঁচ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ
বিধ্বস্ত থাকায় এবং একমাত্র ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রটি নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে
যাওয়ায় সেখানকার মানুষরা দুর্যোগ আতঙ্কে রয়েছেন। এ উপজেলার মোট ১২টি চরে
আশ্রয় কেন্দ্র নেই। সেখানে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস। তাই সেখানকার
মানুষের দূর্যোগ ঝুঁকি বেশি। প্রবীণরা বলছেন, নভেম্বর মাস উপকূলের জন্য
আতঙ্কের মাস। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ও ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড়
সিডরের আঘাতে উপকূলীয় এলাকা ল-ভ- হয়েছিল। যার কারণে নভেম্বর মাসের এই
ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলের মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে।
পায়রা বন্দরের পরিচালক প্রশাসন যুগ্ম সচিব মো. মহিউদ্দিন খান জানান,
ঘুর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর কারনে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকেই আমরা সতর্কতার সাথে
বিষয়টি খোজ খবর রাখছি। সে অনুযায়ী শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে বন্দরের সকল
কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। ছোট খাটো জাহাজগুলো নিরাপদে রাখা
হয়েছে। বন্দরে নিয়োজিত ১৯০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে সকলকে
সর্তক থাকার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আগামীকাল শনিবার
কয়লাবাহী একটি জাহাজ নোঙ্গর করার কথা থাকলেও মেসেজ দিয়ে ওই জাহাজকে না
আসার জন্য বলা হয়েছে। বুলবুল আঘাত হানার বিষয়টি আমরা সার্বক্ষনিক ভাবে
নিবিড় পর্যবেক্ষন করছি।


জেলা ত্রান ও পূনর্বাসন  কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে,
পটুয়াখালীতে ৬৮৯টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব আশ্রয়
কেন্দ্রগুলোতে ইতোমধ্যে প্রায় ৩ লক্ষ ৫৩ হাজার মানুষকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
এসব আশ্রয় কেন্দ্র গুলোর মধ্যে সদর উপজেলায় ১০২টি, কলাপাড়ায় ১৫৩টি,
গলাচিপায় ১০৭টি, রাঙ্গাবালীতে ৫৪টি, দশমিনায় ৬৩টি, বাউফলে ১৪০টি,
মির্জাগঞ্জে ৪৩টি ও মুদকী উপজেলায় ২৭টি। ঘূর্নিঝড় বিপদাপন্ন মানুষের জন্য
৩০০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১২ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা, ২ হাজার প্যাকেট শুকনা
খাবার, ৩ হাজার ৫শত কম্বল, ৩৫০ বান্ডিল ঢেউটিন বরাদ্দ করা হয়েছে, যা স্ব
স্ব উপজেলায় পৌছে দেয়া হয়েছে। এছাড়া শিশু খাদ্যের জন্য ১ লক্ষ টাকা ও
গো-খাদ্যের জন্য ১লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

কলাপাড়া ইউএনও মো: মুনিবুর রহমান জানান, উপজেলার ১৫৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে
ইতোমধ্যে ৬৬ হাজার ৫২০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। বিকেল থেকে আশ্রয়কেন্দ্র
গুলোতে মানুষের উপস্থিতি আরও বাড়ছে। উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের ভাঙ্গা
বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শুক্রবার ট্রলার
থেকে পড়ে সমুদ্রে নিখোঁজ হওয়া জেলের মরদেহ শনিবার বিকেলে কুয়াকাটার
ঝাউবাগান এলাকায় সনাক্ত করেছে তার পরিবার।


কলাপাড়া ঘূর্নিঝড় কেন্দ্রের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট
ঘূর্নিঝড় বুলবুল আরও গতি সঞ্চার করে পায়রা বন্দরের ৩১৫ কি.মি. দক্ষিন
পশ্চিমে অবস্থান করছে। এটি আজ মধ্যরাত অবধি খুলনা ও কুয়াকাটার উপকূলে
আঘাত হানতে পারে। ঘূর্নিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কি.মি. এর মধ্যে বাতাসের
সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৩০-১৫০ কি.মি.। পায়রা বন্দরে ১০ নম্বর মহা বিপদ
সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

এদিকে ত্রান ও পূনর্বাসন কেন্দ্রের তথ্যের সাথে মাঠ চিত্রের ব্যাপক গড়মিল
দেখা দিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এখনও লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতির তথ্য
জানা যায়নি। তবে ঘূর্নিঝড় বুলবুল আতংক ছড়িয়ে একটি বিশেষ মহল ঘূর্নিঝড়
সিডর, আইলা পরবর্তী সময়ের মত ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় লিপ্ত থাকার গুঞ্জন
শোনা গেছে। ঘূর্নিঝড়টি আঘাত হানার পূর্বেই তারা কাগজে কলমে ইতোমধ্যে ক্ষয়
ক্ষতির পরিমান সহ ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের তালিকা করা শুরু করেছেন। এর সাথে
যুক্ত রয়েছে ভিজিএফ, ভিজিডি, সরকারী সেবা-সুবিধা বিতরনে বিতর্কিত কিছু
জনপ্রতিনিধি, ত্রান ও পূনর্বাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতিনিধি।