দর্পণ ডেস্ক : পাঁচ মাস আগে থেকেই আইএস প্রধানকে হত্যার ছক সাজাচ্ছিল সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দ বাহিনী। বারিশা চত্বরে বাগদাদির সম্ভাব্য আস্তানার খোঁজ মেলার পর থেকেই তার প্রতিটা গতিবিধির উপর সতর্ক নজর ছিল সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স জানিয়েছেন, বারিশা এলাকার একটি কম্পাউন্ডে বাগদাদিকে শেষবার দেখা গেছে বলে নিশ্চিত করে সিআইএ। গত শুক্রবারই জঙ্গি নেতাকে খতম করার পুরো পরিকল্পনা সাজানো হয়ে যায় হোয়াইট হাউসে। বাগদাদির ঘাঁটির পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজ দেয় তার আরও এক বিশ্বস্ত অনুচর। আইএস ডেরার পুরো নকশাই কুর্দ বাহিনীকে জানিয়েছিল সে। সেই নকশা তুলে দেওয়া হয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে।
উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ইদলিবের বারিশা চত্বর তখন ঘিরে ফেলেছে মার্কিন ডেল্টা ফোর্স। চিনুক এবং ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার পাক খাচ্ছে আইএস ঘাঁটির মাথার উপরে। গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসে গুলি ছুঁড়ছে জঙ্গিরা। পাল্টা জবাব দিচ্ছে মার্কিন বাহিনী। হোয়াইট হাউসের ‘সিচুয়েশন রুমে’ বসে এই গোটা অপারেশন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায় ‘সিনেমার মতো’ দেখছেন তিনি ও তার শীর্ষ উপদেষ্টারা। আইএস প্রধান নিকেশ অভিযানের সেই ঘণ্টা দুয়েক ছিল টানটান উত্তেজনায় ভরা। সুড়ঙ্গের ভিতরের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা বারে বারেই বলেছেন ডেল্টা ফোর্সের কমান্ডাররা। রুদ্ধশ্বাস সেই ভিডিও এবং অপারেশনের কিছু সাদা-কালো ছবি সামনে আনল পেন্টাগন।
ডেল্টা ফোর্সের সঙ্গে এই অভিযানে ছিল মার্কিন নৌবাহিনী, সিরিয়া ও কুর্দের সেনাবাহিনী। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের মেরিন কর্পস জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি বলেছেন, বারিশার গোটা চত্বরটাই ছিল খানাখন্দে ভরা। ছোটবড় গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছিল বাগদাদির কম্পাউন্ডের বাইরে। এইসব গর্তের আড়ালে লুকিয়ে বসে ঘাঁটি পাহারা দিত আইএস জঙ্গিরা। এদের কাবু করার জন্য এলোপাতাড়ি বোমা বর্ষণ করে মার্কিন বায়ুসেনা। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় একাধিক অস্থায়ী জঙ্গি ঘাঁটি। একদিকে এয়ারস্ট্রাইক, অন্যদিকে লাগাতার গুলি চালিয়ে জঙ্গিদের কোণঠাসা করছিল ডেল্টা ফোর্স। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাগদাদির সুরক্ষা বলয় তছনছ হয়ে যায়। মারা পড়ে তার অধিকাংশ দেহরক্ষী।
কেনেথ জানিয়েছেন, বাগদাদির ডেরায় যখন ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে সেনারা সবচেয়ে আগে প্রতিঘাত আসে জঙ্গি নেতার স্ত্রীদের তরফে। তাদের পরনেও ছিল সুইসাইড ভেস্ট (আত্মঘাতী জ্যাকেট)। কী প্রবল আক্রমণাত্মক ছিল সেই মহিলারা। বাগদাদির দু’জন স্ত্রীকেই গুলিতে উড়িয়ে দেয় মার্কিন সেনা। কেনেথ জানিয়েছেন, গুলি না চালালে আত্মঘাতী জ্যাকেট দিয়ে তারা নিজেদের উড়িয়ে দিত এবং সেই বিস্ফোরণে মারা পড়ত মার্কিন সেনারা।
দেহরক্ষী ও স্ত্রীদের একে একে ধরাশায়ী হতে দেখে ছুটে একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে বাগদাদি। সঙ্গে ছিল তার তিন সন্তান। বাগদাদির পিছু নিয়ে তাকে ধাওয়া করে যায় বেলজিয়ান ম্যালিনয়েস জাতের মার্কিন বাহিনীর ওই জাঁদরেল সেনা-কুকুর। যার ছবি টুইট করে সামনে এনেছিলেন ট্রাম্প। সুড়ঙ্গের ভিতর থেকেও গুলি চালিয়েছিল বাগদাদি। আর্তনাদ করে কেঁধে উঠেছিল। চিৎকার করছিল তার সন্তানেরাও। কারপরই বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গুহা। আত্মঘাতী জ্যাকেটের বোতাম টিপে নিজেকে উড়িয়ে দেয় আইএস প্রধান।
কুর্দ বাহিনীর অফিসার পোলাট ক্যান জানিয়েছেন, বাগদাদির ওই অনুচরের তথ্যের উপর ভিত্তি করেই ডিএনএ মেলানোর জন্য বাগদাদির অন্তর্বাস চুরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন কুর্দের গোয়েন্দারা। রাতের আঁধারে কুর্দের গোয়েন্দা বিভাগের দক্ষ দুই অফিসার যখন আইএসের ডেরায় ঢুকেছিলেন, তাঁদেরকেও সাহায্য করেছিল বাগদাদির ওই ঘনিষ্ঠ অনুচর।
ইরাকের গোয়েন্দা বিভাগ দাবি করেছে, বাগদাদিকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেছে তার আরও এক ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ইসমাইল আল-ইথাউইয়ি। বাগদাদি হত্যার কিছুদিন আগে তুরস্কে গ্রেফতার করা হয়েছিল ইথেউইয়িকে। তার পর তাকে ইরাকের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেখানেই সে বাগদাদি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। বাগদাদির গতিবিধি এবং গোপন ডেরার খবর সেও দিয়েছিল গোয়েন্দাদের। ইথাউইয়ি এবং বাগদাদির ওই অনুচর দু’জনেই ইরাকি এবং কুর্দিশ সেনাদের জানিয়েছিল ঘন ঘন ডেরা বদলে ফেলত বাগদাদি। ধরা পড়া এড়াতে আনাজ-ভর্তি মিনিবাসে চড়ে রণকৌশল নিয়ে আলোচনা চালাত বাগদাদি।