অনলাইন ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘আশ্বাসে’ শাহবাগের অবরোধ তুলে নিয়েছেন কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে আন্দোলনকারীরা।

প্রায় ছয় ঘণ্টা অবস্থানের পর শাহবাগ থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় এ ঘোষণা দেন তারা।

আন্দোলনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোটা বাতিলে শিগগির প্রজ্ঞাপন হবে; এ আশ্বাসে তারা রাজপথের আন্দোলন স্থগিত করেছেন। তবে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন অব্যহত থাকবে।

হাজারো শিক্ষার্থীর অবস্থানে দিনভর অবরুদ্ধ শাহবাগে যান চলাচল বন্ধ থাকায় সারাদিন তীব্র যানজট ছিল পুরো রাজধানীতে। এতে সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েন। কোটা বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও রাজপথ অবরোধের কর্মসূচির সমালোচনা করেন সরকারি দলের নেতারা। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও দিনভর পাল্টাপাল্টি সমর্থন ও সমালোচনা ছিল। এদিন মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক বৈঠকেও আলোচিত হয় কোটা ইস্যু। ঢাকা ছাড়াও দেশের প্রায় সব জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এদিন কোটা বাতিলে অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।

পুলিশ বেষ্টিত হয়ে দিনভর শাহবাগ অবরোধ করে রাখার পর, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফিরে যান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল হক নূর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার আলোকে প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থান নেওয়ার চিন্তা ছিল। তবে কিছুক্ষণ আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া ‘বিশেষ বার্তায়’ প্রজ্ঞাপন জারির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এই আশ্বাসের প্রতি আস্থা রেখে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে, প্রত্যাহার নয়। তবে প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ক্লাশ-পরীক্ষা বর্জন চলবে।

নূরুল হক নূর  জানিয়েছেন, প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে পরিষদের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, দুই-তিন দিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। প্রশাসনের পক্ষে কে বা কারা যোগাযোগ করেছিলেন তা জানাতে রাজি হননি তিনি।

পরিষদের একজন নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম টেলিফোনে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আশ্বাস দিয়েছেন শিগগির প্রজ্ঞাপন জারি হবে।

এর আগে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সোমবার সকাল ১০ টা থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন ও ব্যবসা শিক্ষা অনুষদেরর প্রধান ফটক বন্ধ করে দেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে হাজারো শিক্ষার্থী জমায়েত হন। বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল করে সেখানে আসেন।

আন্দোলনকারীদের মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কয়েকবার প্রদক্ষিণ করে বেলা একটার দিকে শাহবাগ মোড়ে এসে অবস্থান নেয়। এতে অংশ নেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী।

আন্দোলনকারীরা ‘আর নয় কালক্ষেপণ, এবার চাই প্রজ্ঞাপন’, ‘প্রজ্ঞাপনে তালবাহানা, চলবে না চলবে না’, ‘দাবি মোদের একটাই, প্রজ্ঞাপন প্রজ্ঞাপন’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দিব না’, ‘লেগেছে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’ প্রভৃতি স্লোগান দিতে থাকে।

এ সময় শাহবাগ ঘিরে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েত থাকলেও আন্দোলনকারীদের বাধা দেয়নি।

শিক্ষার্থীদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেওয়ার পরও প্রজ্ঞাপন জারি করতে কালক্ষেপণ করে মন্ত্রণালয় ছাত্রসমাজকে উসকে দিচ্ছে। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করছে।

অবস্থানের বিষয়ে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, জাতীয় সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণার ৩৩ দিন পার হলেও তা এখনো প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়নি। তাই ছাত্রসমাজ বাধ্য হয়ে রাজপথে নেমেছে। তারা আন্দোলন করতে করতে ক্লান্ত। আমরা আর আন্দোলন করতে চাই না, পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে চাই। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, আজকের মধ্যেই সচিবদের প্রজ্ঞাপন জারি করার নির্দেশ দিয়ে ছাত্রসমাজকে শান্ত করুন। যদি প্রজ্ঞাপন জারি না করা হয়, তাহলে সারাদেশে সব কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজপথে যে অবস্থান কর্মসূচি নেয়া হয়েছে, তা চলতে থাকবে।

তিনি বলেন, গত ৩ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোজাম্মেল হক খান বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেদিন নির্দেশ দেবেন, তার পরের দিনই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এজন্য কোনো কমিটির দরকার নেই।’ তাহলে তারা কেনো বারবার কমিটির কথা বলছেন? প্রজ্ঞাপন জারির একটি নির্দিষ্ট সময় দিন, তাহলে আন্দোলন প্রত্যাহার করবো।

এদিকে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে কোটা সংস্কারের সারাংশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান জানান, ছাত্ররা দুপুর ১টার দিকে হঠাৎ শাহবাগ মোড়ে এসে বসে পড়ে। এতে শাহবাগের আশেপাশের সমস্ত যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটাতে পারে সেজন্য পুলিশ সতর্ক অবস্থানে ছিল।

ক্লাশ-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি পালিত: এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন বলে জানা যায়। এদের অনেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই ধর্মঘট পালন করা হয়েছে।

যেভাবে শুরু: সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৩ সাল থেকে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা গতি পায়। আন্দোলনকারীদের দাবি, কোটায় ১০ শতাংশের বেশি নিয়োগ নয় এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্যপদ পূরণ করতে হবে।

দাবি আদায়ে গত ৮ এপ্রিল শাহবাগ অবরোধ করে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এদিন পুলিশ তাদের উঠিয়ে দিলে রাতভর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও তাণ্ডব চালায় দুর্বৃত্তরা। কোটার পক্ষে-বিপক্ষে দেশব্যাপী তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা দেন, সরকারি চাকরিতে আর কোটাই থাকবে না। তবে আদিবাসী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। এই ঘোষণার পর আন্দোলন স্থগিত করা হয়। এরপর থেকে আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি জানিয়ে আসছে।