দর্পণ রিপোর্ট : শুভ বিজয়া দশমী। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ও প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার সমাপ্তিপর্ব ”দেবী দুর্গার বিসর্জন”। এই বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার পক্ষকালব্যাপী পৃথিবীতে অবস্থান শেষ হবে। মর্ত্য থেকে দেবী ফিরে যাবেন কৈলাশে। নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে গিয়ে জানিয়ে দেবে তাঁর প্রত্যাবর্তনের খবর।
শারদীয় দুর্গাপূজা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আজ সমাপন ঘটবে।
অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ ও কল্যাণ এবং সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে নিরন্তর শান্তি ও সম্প্রীতির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আজ সমাপন ঘটবে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আজ শুভ বিজয়া। সনাতন হিন্দু বিশ্বাসে-বোধনে ‘অরুণ আলোর অঞ্জলি নিয়ে আনন্দময়ী মা উমাদেবীর আগমন ঘটে। টানা পাঁচ দিন মৃন্ময়ীরূপে মণ্ডপে মণ্ডপে থেকে আজ ফিরে যাবেন কৈলাশে স্বামী শিবের সান্নিধ্যে।’
দেবী দুর্গা মহাশক্তির প্রতিমুর্তি। তিনি জগতের কল্যাণার্থে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নরূপে দেবতা ও মানুষদের বিপদে রক্ষা করেছেন। ‘দ’ অর্থ দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ন নাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। তিনি সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি। শারদীয় দুর্গা পূজায় দেবীকে মহাশক্তির একটি উগ্র রূপ মনে করা হয়। জগতের দেবী দুর্গার দশ হাত। তাঁর বাহন সিংহ। মহিষাসুরমর্দিনী-মূর্তিতে তাঁকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরত অবস্থায় দেখা যায়। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী, এবং কালীর অন্যরূপ।
‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ’ মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে দূর কৈলাশ ছেড়ে মা পিতৃগৃহে আসেন ঘোটকে চড়ে। আজ বিজয়া দশমীতে এয়োস্ত্রীদের দেবীবরণ ও সিঁদুর খেলার পর বিদায় নেবেন আবারও ঘোটকে। আজ সকাল থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে নামবে ভক্তদের ঢল। ঢাক আর শঙ্খধ্বনি। টানা মন্ত্রপাঠ। উলুধ্বনি আর অঞ্জলি। সঙ্গে ঢাকের বাদ্য, নাচ, সিঁদুর খেলা। ধান, দূর্বা, মিষ্টি আর আবির দিয়ে দেবীকে বিদায় জানাবে ভক্তরা।
আজ একদিকে বিদায়ের সুর, অন্যদিকে উৎসবের আমেজ। অনেক হিন্দু আজ উপবাস করবেন। ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, বনানী, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, কলাবাগান, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, স্বামীবাগসহ বিভিন্ন মন্ডপে চলবে আবির উত্সব। সকালে দেওয়া হবে দর্পণ ঘট বিসর্জন। রাজধানীতে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির যৌথ উদ্যোগে বিজয়া শোভাযাত্রা শেষে বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হবে। বিজয়া দশমী উপলক্ষ্যে আজ সরকারি ছুটি। বেতার ও টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হবে। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। বঙ্গভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবন আলোকসজ্জিত করা হবে।
এদিকে গতকাল নীলকণ্ঠ, নীল অপরাজিতা ফুল ও যজ্ঞের মাধ্যমে হিন্দুরা নবমী বিহিত পূজা করেন। নবমী পূজায় যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে আহুতি দেওয়া হয়। ১০৮টি বেলপাতা, আম কাঠ, ঘি দিয়ে এই যজ্ঞ করা হয়। সকালে নবমী বিহিত পূজার মধ্য দিয়ে দিনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পূজা শেষে অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ এবং সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় ভোগ আরতি। শেষবারের মতো ঠাকুর দেখতে মণ্ডপে মণ্ডপে ছিল উপচেপড়া ভিড়। বাসা-বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন করেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। সনাতন বিশ্বাসে ধর্মের গ্লানি আর অধর্ম রোধ, সাধুদের রক্ষা, অসুরের বধ আর ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতি বছর দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা ভক্তদের মাঝে আবির্ভূত হন। শুভ বিজয়ার মাধ্যমে জাগতিক প্রাণীকে শোনান সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণী।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস মতে, বিজয় দশমীতে প্রানপ্রিয় দেবী মা দুর্গাকে বিদায় কিংবা বিসর্জনের ধর্মীয় রীতির মধ্যে দিয়ে আত্মত্যাগের মহান শিক্ষাকে হৃদয়ে পরিস্ফুটিত হয়। মনের সকল কলুষতা, আসুরিকতা, অন্যায় আচরনকে বিসর্জন দিয়ে ত্যাগের মানসিকতায় ভালবাসার বন্ধনে জগতের প্রতিটি মানুষ যাতে তার নিজ নিজ স্বকীয়তা ও ধর্মীয় বিশ্বাসে সুদৃঢ় থেকে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় শান্তিময় জীবন কাটাতে পারে, এ পৃথিবীতে যাতে সকল জীব সুন্দর ও শ্বাশত রূপে নিজেকে বিকশিত করতে পারে, বিজয়ার এ শুভক্ষণে সৃষ্টিকর্তার কাছে সে আর্শিবাদ প্রার্থনা করা হয়।