সবুজবাগের অতীশ দীপঙ্কর সড়ক জামে মসজিদের সামনে পড়ে আছে হলুদ রঙের চারকোনা লোহার দুটি ব্যারিকেড। গায়ে বড় করে লেখা-‘পুলিশ চেকপোস্ট, ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ’। এ ছাড়া রাস্তার অপর প্রান্তে প্রায়ই বসে পুলিশের তল্লাশি চৌকি। এর ৫শ গজের মধ্যেই সবুজবাগ থানার অবস্থান। থানা ঘিরেও রয়েছে পুলিশের সতর্ক অবস্থান। পাশের খিলগাঁও ফ্লাইওভারের শুরুতে মানুষের ব্যস্ত আনাগোনা।

তবে এতকিছুর পরও গত শনিবার দুপুরে একটি স্কুলের সামনে থেকে প্রকাশ্যে কালো কাচের কালো মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয় স্বনামধন্য এক আইনজীবীর মেয়েকে। পরীক্ষা দিতে রিকশাযোগে স্কুলে যাচ্ছিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের (মুগদা শাখা) দশম শ্রেণির ওই ছাত্রী। গাড়িটিতে মাঝ বয়সী এক নারী ও চালকসহ চার যুবক এবং অপহরণের শিকার আরও দুই কিশোরী ছিল। পরে নিজের বুদ্ধিমত্তায় গাড়ি থেকে পালিয়ে রক্ষা পায় আইনজীবীর ওই মেয়ে।

প্রকাশ্য দিবালোকে এ অপহরণকাণ্ডের দুই দিন পেরিয়ে গেলেও ঘটনায় জড়িতদের আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উদ্ধার করা যায়নি ওই দুই কিশোরীকেও। ফলে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানা যায়নি। তাদের অবশ্য জাহাজে করে বিদেশে পাচারের পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছিল পালিয়ে আসা আইডিয়াল ছাত্রী। ভুক্তভোগী কিশোরী মধ্য বাসাবোর একটি বাসার পাঁচ তলায় মা-বাবার সঙ্গে থাকে। গতকাল দুপুরে সেখানেই কথা হয় পরিবারের সঙ্গে।

কিন্তু মেয়েটি এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত যে, অপরিচিত কাউকে দেখলেই ভয় পাচ্ছে। আতঙ্ক এখনও পিছু ছাড়েনি তার। গতকাল রবিবার তার রসায়ন পরীক্ষা ছিল। তাতে অংশ নেওয়া তো দূরের কথা, ভয়ে ঘর থেকেই বের হতে সাহস পাচ্ছে না সে। ওই শিক্ষার্থীর মা আমাদের সময়কে জানান, শনিবার আড়াইটার দিকে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার পরীক্ষা ছিল তাদের মেয়ের। তাই দুপুর ২টার দিকে বাসার সামনে থেকে একটি রিকশায় স্কুলের উদ্দেশে তাকে তুলে দেন। বাসাবো ফ্লাইওভারের ঢালে অতীশ দীপঙ্কর সড়ক জামে মসজিদের অদূরে একটি স্কুলের সামনে পৌঁছতেই কালো গ্লাসের একটি মাইক্রোবাস হঠাৎ রিকশার সামনের চাকা ঠেকিয়ে থামে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটিকে টেনেহিঁচড়ে দুই যুবক মাইক্রোবাসে তুলে নেয়।

তখন চালক ছাড়াও গাড়ির সামনের সিটে একজন, পেছনের আসনে দুই কিশোরী ও দুই যুবক বসা ছিল। তারও পেছনের সিটে মাঝ বয়সী এক নারীকে বসা দেখতে পায় মেয়েটি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুমালে মাখা উৎকট গন্ধের কিছু একটা শুঁকিয়ে দেওয়া হয় তাকে। এতে প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে সে। এভাবে গাড়ি চলে পৌনে এক ঘণ্টা। কিছুটা জ্ঞান ফিরতেই সে চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করে। তার দেখাদেখি ভেতরে থাকা দুই কিশোরীও হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করে বাঁচার আকুতি জানায়। কিন্তু পেছনে বসা মাঝ বয়সী নারী ও পাশে থাকা দুই যুবক তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা চালায়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পুরান ঢাকার বাবুবাজার ব্রিজের গোড়ায় আইনজীবীর মেয়ে কৌশলে গাড়ির সুইচ চেপে দরজা খুলে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে। কোনো কিছু না ভেবেই দৌড়ে কেরানীগঞ্জগামী একটি বাসে উঠে পড়ে।

গাড়িটি বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু পেরিয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন এলাকায় কদমতলী বাবুবাজার ব্রিজের প্রান্তে আসতেই সে বাস থেকেও লাফিয়ে নেমে যায়। এর পর হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেনের ফলের দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তখন বেলা প্রায় সাড়ে ৩টা। এ বিষয়ে ফলের দোকানি দেলোয়ার হোসেন জানান, মেয়েটি প্রথমে ঠিকমতো কথা বলতে পারছিল না। অঝোরে কাঁদছিল। কেবল বলছিল-‘ওরা আমাকে কিডন্যাপ করেছে, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে, আমাকে বাঁচান। আমি আম্মুর কাছে যাব।’

কিন্তু কারা, কোথায় থেকে অপহরণ করেছে-জানতে চাইলে সে শুধু তার মায়ের মোবাইল ফোন নম্বরটিই বলতে পেরেছে। এর পর অচেতন হয়ে পড়ে যায় মেয়েটি। তখন সঙ্গে থাকা আইডি কার্ড থেকে তার পরিচয় জানতে পেরে ওই মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে সব ঘটনা খুলে বলেন দেলোয়ার হোসেন। খবর পেয়ে মেয়েটির বাবা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।

অপহৃত মেয়ের বরাত দিয়ে তার মা আরও জানান, মাইক্রোবাসে জ্ঞান থাকাকালীন অপহরণকারীদের কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের মেয়ে জানতে পারে, অপর দুই কিশোরীও একইভাবে অপহরণের শিকার। সামনের সিটে বসা অপহরণকারীদের দলনেতা বলছিল-‘এই মেয়েটিকে (আইনজীবীর মেয়ে) আলাদা রাখ। কাজ শেষে তিনটারে (কিশোরী) নিয়া বালুর মাঠে গাড়ি থামাবা।

এর পর জাহাজে ওদের চালান দিবা (পাচার)।’ অপহরণকারীরা নারী বা কিডনি পাচারকারী দলের সদস্য-এমন ধারণা পোষণ করে মেয়েটির মা বলেন, ‘লোক মুখে আমি জানতে পেরেছি, আমাদের মেয়েকে যেখান থেকে অপহরণ করা হয় সেই রাস্তার উল্টো পাশে পুলিশ চেকপোস্ট ছিল।’ আর কেউ অপহরণ হওয়ার আগেই চক্রটিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান তিনি।

এদিকে গতকাল দুপুর ২টার দিকে ওই কিশোরীর জবানবন্দি নিতে তার বাসায় আসেন সবুজবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোহরাব হোসেন। এ সময় তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘এই অপহরণকাণ্ডের অভিযোগ গ্রহণ করেছি। ধারণা করা হচ্ছে, মেয়েটি পাচারকারীদের কবলে পড়েছিল। তবে বুদ্ধিমত্তার জোরে সে বেঁচে গেছে। তার বক্তব্য অনুযায়ী কারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের শনাক্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনা হবে।’

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের (মুগদা শাখা) সহকারী প্রধান শিক্ষক কাজল কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘এমন একটি ঘটনায় অন্য শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মাঝেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঘটনাটি আমার স্কুলের সামনে না, বাসাবো ফ্লাইওভারের কাছে ঘটেছে বলে শুনেছি। অপহরণের ফলে ওই শিক্ষার্থী ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা পরীক্ষা দিতে পারেনি। রবিবারও সে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।’