দর্পণ ডেস্ক : জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩,৭৭,৮১০ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয় ২,১১,৬৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল এডিপির পরিমাণ ২,০২,৭২১ কোটি টাকা। আর সরকারের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩,১০,২৬২ কোটি টাকা। বিশাল আকারের এই বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১,৪৫,৩৮০ কোটি টাকা। নতুন এই অর্থবছরে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। গতকাল জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, দেশি-বিদেশি মেহমানদের উপস্থিতিতে বিকাল ৩টায় এ বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর অসুস্থতাজনিত কারণে পরে অবশ্য স্পিকারের অনুমতিক্রমে বাজেটের বাকি অংশ প্রধানমন্ত্রী উপস্থাপন করেন।

প্রস্তাবিত এই বাজেটে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে একটি কমিশন গঠন ও ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা, শেয়ারবাজারের জন্য প্রণোদনা প্রদান, গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারগুলো অর্থনীতির পাওয়ার হাউস হিসেবে গড়ে তোলা, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া, ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্ক বাস্তবায়নসহ আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিকাশে পাদুকাশিল্প, পাটশিল্প, বস্ত্রশিল্পসহ সব ধরনের স্থানীয় শিল্পে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ স্লোগানকে সামনে রেখে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক শহরের সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার করে গ্রামীণ উন্নয়ন বরাদ্দ বাড়িয়েছেন। এ অর্থে গ্রামের অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামের হাট-বাজারগুলোকে অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়াও গ্রামের মানুষের কাছাকাছি প্রশাসনিক ক্ষমতা পৌঁছে দেওয়া, দ্রুত গতির ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দেওয়া এবং আগামী অর্থবছরে পল্লী অঞ্চলে নতুন করে সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। ৩০,৫০০ মিটার ব্রিজ, ১৩ হাজার কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৩৭০০ মিটার কালভার্ট, ১৯০টি গ্রোথ স্টোর বাজার উন্নয়ন ও ৬৪টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

এর বাইরে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষিত বেকারদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ঋণ দেয়ার জন্য বিশেষ তহবিল গঠন, নারী উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা, প্রবাসীদের জন্য বীমা ব্যবস্থা চালু করা, তৈরি পোশাকশিল্পে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এবারের বাজেটে বহুল আলোচিত ভ্যাট আইন কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে ভ্যাটের আওতা ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। ফলে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিছু খাতে ভ্যাটের হার কমানো হয়েছে। এক স্তরের পরিবর্তে বহু স্তর ভ্যাট আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো- ৫, ৭ দশমিক ৫, ১০ এবং ১৫ শতাংশ।

এর আগে টানা চার বছর করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়েনি। সেই ধারাবাহিকতায় করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকাই রইল। ফলে টানা ৫ বছর ধরে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। এতে অনেক ব্যক্তি নতুন করে করজালে ঢুকে পড়বেন। এভাবে ভ্যাট ও করের জাল বাড়ানো হয়েছে। করের আওতা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অনেকে একে নতুন করজালের বাজেট বলে অভিহিত করেছেন।

প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছেন। বাজেটে তিনি অনেকগুলো বিষয় নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন। এর মধ্যে বিশেষ জনগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান তৈরির জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। বাজেট বক্তৃতায় ২০৩০ সালের মধ্যে তিনি ৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে দেশের বেকার সমস্যার সমাধানের কথা বলেছেন।

এছাড়া বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনার জন্য আগামী অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ খাতে আগামী অর্থবছরের জন্য ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া প্রবাসী কর্মীদের বীমার আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে পোশাক খাতসহ সর্বোচ্চ ৪টি খাতে ৪ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে সব খাতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১ শতাংশ হারে রপ্তানি প্রণোদনার প্রস্তাব করেন মুস্তফা কামাল। এ খাতে প্রণোদনা বাবদ ২ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে অতিরিক্ত ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাজেটে বেশ কিছু সংস্কারের কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সঞ্চয়পত্র কেনা-বেচা আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র ক্রয় নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। ইএফটির মাধ্যমে পেনশন প্রদানের উদ্যোগের কথাও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া সরকারি কর্মচারীদের গ্রুপ বীমার আওতায় আনতে সমন্বিত বীমা ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে। আগের অর্থবছরে ঘোষণা দেওয়া সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর বিষয়টিকে আরও ত্বরান্বিত করতে শিগগিরই ইউনিভার্সেল পেনশন অথরিটি গঠন করার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

এছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে কালো টাকা বিনিয়োগ করলে কোনো প্রশ্ন তোলা হবে না। এতে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া আরও সহজ করা হয়েছে। করপোরেট করহারও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে করমুক্ত লভ্যাংশ ২৫ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া বোনাস শেয়ার এবং রিজার্ভ ৫০ শতাংশের বেশি হলে ১৫ শতাংশ নতুন করে করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।

একইভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা মাথায় রেখে এবং রাজস্ব আয় বাড়াতে সব ধরনের তামাক পণ্যের ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আইসক্রিমের ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ, হেলিকপ্টারে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। মোবাইল সিম বা রিম কার্ডের ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।

অন্যদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং, ক্লিয়ারিং ও ফরোয়ার্ডি সংস্থা, ব্যাংকিং সেবা, বীমা কোম্পানির সেবার ওপর মূসক অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসা-বিনিয়োগে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের ও পিপিপি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সব ধরনের ভাতা ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ খাতে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বাজেটের ১৪ দশমিক ২১ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাখা হয় ৬৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা।

বাজেটে অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের ভাতাভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১৫ লাখ ৪৫ হাজার করা হয়েছে। বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা ১০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতাভোগীর সংখ্যা ১৪ লাখ থেকে ১৭ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৪০ লাখ থেকে ৪৪ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে উপকারভোগীর সংখ্যা ৬ হাজারে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।