দর্পণ ডেস্ক : নতুন শ্রমবাজার তৈরি বা বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালে নানা প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হচ্ছে সরকারকে। এমন পরিস্থিতিতে বেশকিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কায় পরিস্থিতি আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। এই সংকট মোকাবেলায় বিকল্প শ্রমবাজার তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশের টার্গেট এখন পোল্যান্ড, আলজেরিয়া ও জাপানসহ সাত দেশ। এসব দেশের শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্তির জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগের বছরের হিসাবে বিদায়ী বছরে বিদেশে কর্মী পাঠানোর হার কমেছে। তারপরও রেমিট্যান্সে কোনো প্রভাব পড়েনি, বরং দুই লাখ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রত্যাশানুযায়ী রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত রাখতে এরই মধ্যে নতুন শ্রমবাজারের সন্ধান শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের সংকুচিত শ্রমবাজারের বিকল্প হিসেবে পোল্যান্ড ও আলজেরিয়ার মতো দেশকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমেদ জানান, শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়- জাপানসহ বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানিতে সরকার সচেষ্ট। এ ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। ইউরোপসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে এরই মধ্যে সাড়া পাওয়া গেছে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন শ্রমবাজারের সন্ধানসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এগুলো হচ্ছে- বিদেশে গমনেচ্ছুক কর্মীদের জন্য শক্তিশালী ডাটাবেজ তৈরি করা, নারী কর্মীদের নিরাপদ অভিবাসনসহ অভিবাসী কর্মীদের নিরাপত্তা ও বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানো নিশ্চিত করা এবং উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত ও জনবল সংকট নিরসন করা।
নতুন শ্রমবাজার প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, বিশ্ববাজারে স্থান করে নিতে দক্ষ জনশক্তি তৈরির ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশি শ্রমিকদের দক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয় তা মোকাবেলা করতে হবে। সরকারের সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে সুশাসন আনতে না পারলে শ্রম অভিবাসন খাতে তাদের লক্ষ্য অর্জন দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার জনশক্তি রফতানিতে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে। দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিদেশে দক্ষ ও অদক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সেই আলোকে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে। এরপরও বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে অভিবাসন ব্যয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি জটিলতা পোহাতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য অভিবাসন ব্যয় কমানো, সরকারি দলের সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী প্রতি উপজেলা থেকে ১ হাজার কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান করা, এসডিজি, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও গ্লোবাল কম্প্যাক্ট ফর মাইগ্রেশনের অঙ্গীকার অনুযায়ী নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, নিয়মিত ও দায়িত্বশীল অভিবাসন নিশ্চিত করা, শ্রম অভিবাসনে নিয়োজিত রিক্রুটিং এজেন্টগুলোর কার্যক্রমে তদারকি এবং শ্রম অভিবাসনে নিয়োজিত মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালদের জবাবদিহির কাঠামোতে আনতে হবে বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।
শ্রম অভিবাসন সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে ২০০৯-২০১৬ সাল পর্যন্ত বিদেশে কর্মী পাঠানোর এবং রেমিট্যান্স প্রাপ্তির একটি চিত্র পাওয়া গেছে। ২০০৯ সালে বিদেশে বাংলাদেশি কর্মী ছিল ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৮ জন। রেমিটেন্স এসেছে ১০ হাজার ১৭১ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালে কর্মী গমনের হার কমে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৭০২ জনে নেমে এলেও ওই বছর রেমিট্যান্স এসেছে ১১ হাজার ৪ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলার। ২০১১ সালে কর্মী গেছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬২ জন, রেমিট্যান্স এসেছে ১২ হাজার ১৬৮ দশমিক ০৯ মিলিয়ন ডলার। ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ জন কর্মী গেছেন ২০১২ সালে। ওই বছর রেমিট্যান্স আয় হয়েছে ১৪ হাজার ১৬৩ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন ডলার। ২০১৩ সালে ৪ লাখ ৯ হাজার ২৫৩ জন কর্মীর বিপরীতে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩ হাজার ৮৩২ দশমিক ১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৪ সালে কর্মী গেছেন ৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৮৪ জন, রেমিট্যান্স এসেছে ১৪ হাজার ৯৪২ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে গেছেন ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন, রেমিট্যান্স আয় হয়েছে ১৫ হাজার ২৭০ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৬ সালে ৭,৫৭,৭৩১ জন কর্মীর বিপরীতে এসেছে ১৩ হাজার ৬০৯ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন ডলার।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কূটনৈতিক তৎপরতায় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা হয়। সেই সূত্রে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের কর্মী পাঠানো শুর হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ২০০১ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়তে থাকে। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বর্তমানে চলমান প্রকল্প রয়েছে আটটি- এর মধ্যে ছয়টি বিনিয়োগ এবং দুটি কারিগরি প্রকল্প। এ ছাড়া শ্রম অভিবাসনের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১৪টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি হয়েছে। ১৯৭৬-২০১৮ সাল পর্যন্ত শ্রম অভিবাসনের সংখ্যা ১ কোটি ২২ লাখ। এ সময়ে রেমিট্যান্স পাওয়া গেছে প্রায় ১৩ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
তবে বিদায়ী বছরে কর্মী গমনের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে অভিবাসী কর্মী ছিল ১০ লাখ। রেমিট্যান্স এসেছে ১৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৩৪ হাজারে। এ বছর নারী কর্মীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৫ জন। বিদায়ী এই বছরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সংশ্নিষ্টরা জানান, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ায় গত বছর কর্মী গমনের হার কমেছে। এই সংকট মোকাবেলার জন্য নতুন শ্রমবাজার সম্প্রসারণে তৎপরতা চালাচ্ছে মন্ত্রণালয়। জাপানসহ সাতটি দেশের শ্রমবাজার খুলছে শিগগির। একই সঙ্গে সিসেলস, ফিজি, সুদান, পালাও, পোল্যান্ড ও আলজেরিয়ায় জনশক্তি রফতানি বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা চলছে।