দর্পণ ডেস্ক : কখনো মন্দ মানুষ, কখনো হাস্যরসের ভাণ্ডার নিয়ে উপস্থিত এক চিরচেনা মুখ। যখনই যে চরিত্রে তিনি পর্দায় হাজির হয়েছেন দর্শকদের  দিয়েছেন ভিন্ন স্বাদের বিনোদন। চলচ্চিত্রে গ্রাম্য বদ মাতব্বর, নানা ধরনের দুষ্ট লোক কিংবা গতানুগতিকের চেয়ে অন্য ধারার কমেডি চরিত্রে অভিনয় করে তিনি পেয়েছেন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। তিনি এটিএম শামসুজ্জামান। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা, পরিচালক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা ও গল্পকার। তার পুরো নাম আবু তোরাব মোহাম্মদ শামসুজ্জামান। এ যাবৎ ৩০০ শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রে এটিএম শামসুজ্জামানের যাত্রা শুরু সহকারী পরিচালক হিসেবে।

১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘মানুষের ভগবান’ ও ‘বিষকন্যা’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন তিনি। এরপর বিভিন্ন পরিচালকের সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এদের মধ্যে খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্ত অন্যতম। এরপর অভিনয়ে থিতু হন তিনি। ১৯৬৫ সালে সর্বপ্রথম চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লিখেন এটিএম শামসুজ্জামান। লেখালেখিতে তিনি অল্প সময়ে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন।  এ পর্যন্ত শতাধিক চিত্রনাট্য ও কাহিনী লিখেছেন। তিনি অভিনয় শুরু করেন ১৯৬৫ সালের দিকে। প্রথম দিকে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে সর্বপ্রথম ‘পান বিক্রেতা’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি।  এরপর ১৯৭৬ সালে প্রয়াত দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন। এ ছবিতে খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করেই এটিএম শামসুজ্জামান তার অভিনয় জীবনের টার্নিং পয়েন্টে খুব অল্প সময়ে পৌঁছে যান। ছবিটিও দর্শকপ্রিয়তা পায়। ফলে পরিচালকরাও তাকে একের পর এক খলনায়ক চরিত্রে কাস্ট করতে শুরু করেন।

নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রেও খল চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ সুখ্যাতি পেয়েছেন তিনি। এছাড়া খল চরিত্রে তার অভিনীত আরো কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো ‘অশিক্ষিত’, ‘গোলাপী এখন  ট্রেনে’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘স্বপ্নের নায়ক’ ইত্যাদি। খলনায়কের পাশাপাশি এটিএম শামসুজ্জামান কৌতুক অভিনেতা হিসেবেও দারুণ সফলতা পান । বিশেষ করে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে ‘জলছবি’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘রামের সুমতি’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘ভণ্ড’, ‘চুড়িওয়ালা’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’সহ বেশকিছু চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করে খ্যাতি পান। এ ছাড়াও বেশ কিছু চলচ্চিত্রে তিনি পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনয় করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘অনন্ত প্রেম’, ‘দোলনা’, ‘অচেনা’, ‘মোল্লা বাড়ির বউ’, ‘হাজার বছর ধরে’ ইত্যাদি। তার অভিনীত অন্যান্য ছবির মধ্যে রয়েছে ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘লাল কাজল’, ‘পুরস্কার’, ‘প্রিন্সেস টিনা খান’, ‘ঢাকা ৮৬’, ‘দায়ী কে’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘তোমার জন্য পাগল’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘আমার স্বপ্ন তুমি’, ‘এবাদত’, ‘পরান যায় জ্বলিয়ারে’, ‘কুসুম কুসুম প্রেম’, ‘ গেরিলা’, ‘লাল টিপ’, ‘ চোরাবালি’, ‘দ্য স্টোরি অব সামারা’, ‘পাংকু জামাই’ ইত্যাদি। এটিএম শামসুজ্জামান ২০০৯ সালে প্রথম পরিচালনা করেন শাবনূর-রিয়াজ জুটিকে নিয়ে ‘এবাদত’ নামের ছবিটি। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অসংখ্য নাটকেও অভিনয় করেছেন তিনি। ১৯৬৩ সালে টিভি নাটকে তার অভিষেক। প্রথম নাটক বিশিষ্ট টিভি ব্যক্তিত্ব ও নাট্যকার আশকার ইবনে শাইখ পরিচালিত ‘লাঠিয়াল বাহিনী’। তার অভিনীত অন্যান্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রঙের মানুষ’, ‘ভবের হাট’, ‘ঘর কুটুম’, ‘বউ চুরি’, ‘নোয়াশাল’, ‘শতবর্ষে দাদাজান’ ইত্যাদি। এটিএম শামসুজ্জামান ‘দায়ী কে’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’ ও ‘চোরাবালি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য ২০১৫ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক।

বার্ধক্যের কারণে দীর্ঘদিন অভিনয় থেকে দূরে থাকলেও মাঝেমধ্যেই শখের বশে অভিনয় করতে দেখা যায় এটিএম শামসুজ্জামানকে। এই সময়ে শুধু টিভি নাটকেই অভিনয় করছিলেন। এদিকে তার অভিনীত এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ‘আলফা’ ছবিটি গত ২৬ এপ্রিল দেশের চারটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। ব্যক্তিজীবনে এটিএম শামসুজ্জামান বিনয়ী, সদালাপী, মিশুক এবং স্পষ্টবাদী মানুষ। ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার ভোলাকোটের বড় বাড়ি আর ঢাকায় থাকেন রাজধানীর  সূত্রাপুর থানার দেবেন্দ্রনাথ দাস লেনে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার পগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল এবং রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলে। পগোজ স্কুলে তার বন্ধু ছিল চলচ্চিত্রের আরেক অভিনেতা প্রবীর মিত্র। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাইস্কুল থেকে। তারপর জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন।

তার পিতা নূরুজ্জামান ছিলেন নামকরা উকিল এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। মাতা নুরুন্নেসা বেগম। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে এটিএম শামসুজ্জামান সবার বড়। তার স্ত্রীর নাম রুনি জামান। তাদের তিন ছেলের মধ্যে দুজন জীবিত।

উল্লেখ্য, ৭৮ বছর বয়সী এটিএম শামসুজ্জামান গত ২৬ এপ্রিল রাতে বাসায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। সেদিন রাত ১১টার দিকে তাকে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন তার শরীরে একটা অস্ত্রোপচার করা হয়। ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দেয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তখন তাকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। এরপর ৩ মে লাইফ সাপোর্ট খুলে দিয়ে স্বাভাবিক খাবার নেয়ার পর পরই তিনি অসুস্থবোধ করলে তাকে আবারো লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এটিএম শামসুজ্জামানের ছোট ভাই সালেহ জামান সেলিম সবশেষ বলেন, ভাইকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছে তার। তবে শ্বাস-প্রশ্বাসের পাশাপাশি অ্যাজমার সমস্যাটা নিয়ন্ত্রণে আছে। তার শ্বাস ৭০ ভাগ কাজ করছে। বাকি ৩০ ভাগের জন্য তাকে এখনো লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তবে তার অবস্থা আগের চেয়ে স্থিতিশীল। ভাইয়ের সুস্থতার জন্য দেশ-বিদেশের সকলের কাছে দোয়া চেয়েছনে তিনি।