দর্পণ ডেস্ক : চার সন্তানের জননী মানসিক ভারসাম্যহীন রোজিনা। শিশু কান্না করলে বকাও দিচ্ছেন। নিজেই আবার বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন শিশুটিকে। হঠাৎ নিরব হয়ে প্রলাপ বকছেন নিজে-নিজেই।
এভাবেই কাটছে এখন রোজিনার দিন। পাশে রয়েছেন মা-মেয়ের দেখবালের দায়িত্বে থাকা ফারজানা আক্তার নামের এক নারী। ফারজানা নিজেও শিশুটিকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন।
শুক্রবার সরেজমিনে নগরীর আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গাইনি ওয়ার্ডে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়।
ফারজানা জানান, নগরীর ডবলমুরিং থানার এসআই মাসুদুর রহমান তাকে এ কাজে নিয়োজিত করেছেন। তিনি ফুটপাতে প্রসবকালীন অবস্থা থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তির করান রোজিনাকে। এরপর থেকে মা-মেয়ের দেখাশুনা করছেন ফারাজানা। তবে গত ৫ বছর ধরে চেনেন রোজিনাকে। এই সুবাদেই তাকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়।
এদিকে ফুটফুটে কন্যা শিশুটিকে লালন-পালনের (দত্তক) দায়িত্ব নিতে অনেকেই এসআই মাসুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এরমধ্যে ২৫ জন দম্পত্তি রয়েছেন নিঃসন্তান। এমন একটি তালিকা করেছেন এসআই মাসুদ।
গত সোমবার রাত ৮টার দিকে আগ্রাবাদ জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সামনের ফুটপাতে রাস্তার প্রসব বেদনায় ছটফট করতে থাকে পাগলী রোজিনা। এসময় উৎসুক জনতা ওই পাগলীকে ঘিরে ভিড় করলেও কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি।
খবর পেয়ে ছুটে আসেন ডবলমুরিং থানার এসআই মাসুদুর রহমান। তিনি দ্রুত মা ও শিশুকে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কাটা হয় নাড়ি। সংকটাপন্ন প্রাণে বাঁচলেন মা ও শিশু প্রাণে বাঁচেন। বর্তমানে হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের ৪২নম্বর সিটে চিকিৎসাধীন।
মানসিক ভারসাম্যহীন রোজিনা সর্ম্পকে জানত চাইলে দেখভালকারী ফারজানা বলেন, ‘তিন ছেলে ও এক মেয়ের জননী রোজিনা। বর্তমানে সদ্য ভুমিষ্ঠ হওয়া এই কন্যা শিশু ও ৮ বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। বাকি দুই ছেলেকে জন্মের পর বিক্রি করে দিয়েছে তার বাবা। এখনো খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছে। গত তিন বছর ধরে নিয়মিত খোঁজ-খবর নেয় না। বিভিন্ন মাজারে-মাজারে পড়ে থাকে। আর রোজিনা রাস্তায় ভবঘুরে হিসেবে ঘুরে বেড়ায়। মানুষের কাছে খাবার খুঁজে খায়। কেউ-কেউ নগদ টাকা দেয়। মাঝে মধ্যে এসে ওই টাকা তার (রোজিনা) কাছ থেকে নিয়ে যায়। মূলত বিক্রি করে দেয়া ছেলেদের শোকেই ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারায় রোজিনা।’
রোজিনার সেই স্বামী হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে শিশু চুরির আশঙ্কায় জাবেদ নামে একজনকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব দিয়েছেন এসআই মাসুদ। তিনি গত মঙ্গলকার থেকে গাইনি ওয়ার্ডের আশপাশে থাকছেন। রাত ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালে থাকেন বলে জানান তিনি।
তবে এই খবরে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও মানবিক কাজে সহায়তা দিতে আগ্রহী লোকজন প্রতিদিন হাসপাতালে আসছেন। সামর্থ অনুযায়ী নগদ অর্থ, শীতবস্ত্র ও খাবার নিয়ে আসছেন অনেকে।
বুধবার মানবিক কাজে এগিয়ে আসায় এসআই মাসুদুর রহমানকে পুরস্কৃত করেছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার। সনদ ছাড়াও নগদ অর্ধলাখ টাকা পুরস্কার হিসেবে প্রদান করেছেন সিএমপি কমিশনার মাহবুবর রহমান।
এ প্রসঙ্গে এসআই মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ফুটপাতে ভুমিষ্ঠ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তির খবরের পর থেকে বিভিন্ন লোকজন ফুটফুটে শিশুটির দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন। এমন একটি তালিকা করা হয়েছে। এরমধ্যে ২৫ জন রয়েছেন নিঃসন্তান দম্পত্তি। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন আদালত।’
তিনি বলেন, ‘ইসমাইল নামে এক ব্যক্তি রয়েছেন ওই নারীর স্বামী। তবে তিনি তার খোঁজ খবর রাখতেন না। কিন্তু নবজাতক ভুমিষ্ঠ হওয়ার খবরে হাসপাতালে স্বশরীরে উপস্থিত হয়েছে ইসমাইল। নিজেকে পাগলী রোজিনার ভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতকের পিতা বলে পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু পূর্বে তার দুইটি ছেলেকে বিক্রি করে দিয়েছে জেনেছি। তবে এ ব্যাপারে এখনো তদন্ত করা যায়নি।’