পক্ষপাতের অভিযোগ এনে প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন ৯২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাদের বদলি করার দাবি জানিয়ে পৃথক চিঠি দিয়েছে বিএনপি। এ তালিকায় নির্বাচন কমিশন (ইসি), জনপ্রশাসন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ প্রশাসনের ২২ জন কর্মকর্তা এবং পুলিশের অতিরিক্ত আইজি, র্যাবের মহাপরিচালক, ডিএমপি কমিশনারসহ ৭০ জন পুলিশ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। এসব কর্মকর্তাকে বিতর্কিত উল্লেখ করে তাদের প্রত্যাহারসহ নির্বাচন সংক্রান্ত সব ধরনের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখারও দাবি জানিয়েছে দলটি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার এ তালিকা কমিশনে জমা দেয়। এ সময় দলের পক্ষ থেকে মোট ১৩টি চিঠি দেয়া হয়। এসব চিঠিতে সরকারের উন্নয়ন প্রচার বন্ধ, এক থানার নির্বাচন কর্মকর্তাদের অন্য থানায় বদলি, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার তালিকা থেকে দলবাজদের বাদ দেয়া। এসব চিঠিতে স্বাক্ষর করেন বিএনপির মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সাংবাদিকদের এ বিষয়ে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সরকারের এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে দালিলিক প্রমাণ জমা দিয়েছি।
প্রমাণাদিসহ নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর সরকার কিংবা নির্বাচনী কোনো কর্মকর্তা যে কাজগুলো করতে পারেন না- সেই কাজগুলো অনবরত করা হচ্ছে। তার কয়েকটি উদাহরণ আমরা উনাদের সামনে তুলে ধরেছি এবং এগুলোর প্রতিকার চেয়েছি।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব চট্টগ্রাম বিভাগের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। পরবর্তীকালে ২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনের বিভাগীয় কমিশনার ও রিটার্নিং কর্মকর্তা তার এলাকার অন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। এটি নির্বাচন আচরণিবিধির ৭৩-এর ২বি, ৭৭-এর ১/ই এবং আরপিওর লঙ্ঘন।
বিএনপির প্রতিনিধি দল যখন নির্বাচন কমিশনে এ চিঠি জমা দেয়, ঠিক তখনই ভবনে সারা দেশের পুলিশ সুপার ও এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন কমিশন।
এক চিঠিতে ইসি সচিবসহ ২২ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করেছে দলটি। এতে কর্মকর্তাদের নামের পাশে বর্তমান সরকারের সময়ে কোথায় চাকরি করেছেন, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়, আগে কোন মন্ত্রীর অধীনে চাকরি করেছেন তা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে রাজশাহী বিভাগের কমিশনার হিসেবে সেখানে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করায় পুরস্কার হিসেবে ইসি সচিব পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
বিসিএস ৮২, ৮২ (বিশেষ) ও ৮৪ ব্যাচের শতাধিক কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে তাকে সচিব পদে পদায়ন করা হয়েছে। জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহমেদের চাকরি জীবনের তথ্য তুলে ধরে চিঠিতে বলা হয়েছে, তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিনও ছাত্রলীগ করতেন।
বাকি কর্মকর্তারা হলেন- চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান, খুলনার বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া, ভোলার ডিসি মো. মাসুদ আলম সিদ্দিকী, চট্টগ্রামের ডিসি মো. ইলিয়াস হোসাইন, কুমিল্লার ডিসি মো. আবুল ফজল মীর, ফেনীর ডিসি মো. ওয়াহিদুজ্জামান, লক্ষ্মীপুরের ডিসি অঞ্জন চন্দ্র পাল ও কিশোরগঞ্জের ডিসি মো. সরোয়ার মোরশেদ চৌধুরী।
এছাড়া তালিকায় আছে নরসিংদীর ডিসি সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন, টাঙ্গাইলের ডিসি মো. শহিদুল ইসলাম, ঝিনাইদহের ডিসি সরোজ কুমার নাথ, খুলনার ডিসি মোহাম্মদ হেলাল হোসাইন, কুষ্টিয়ার ডিসি মো. আসলাম হোসাইন, নড়াইলের ডিসি আঞ্জুমান আরা, ময়মনসিংহের ডিসি ড. শুভাস চন্দ্র বিশ্বাস, জয়পুরহাটের ডিসি মোহাম্মদ জাকির হোসাইন, নওগাঁর ডিসি মো. মিজানুর রহমান, রাজশাহীর ডিসি এসএম আবদুল কাদের ও সিলেটের ডিসি কাজী ইমদাদুল হক। অন্য জেলার ডিসিদের পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিএনপির অপর এক চিঠিতে পুলিশের ৭০ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, পুলিশ প্রশাসনের অতি দলবাজ ও চিহ্নিত বিতর্কিত কর্মকর্তারা নির্বাচনী মাঠ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এ তালিকায় পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ও ব্যাচ, নিজ জেলা ও পদবি উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়নি।
এই তালিকায় রয়েছেন এডিশনাল আইজিপি (প্রশাসন) মোখলেছুর রহমান, র্যাবের ডিজি বেনজীর আহম্মেদ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, এডিশনাল আইজি (টেলিকম) মো. ইকবাল বাহার, ডিআইজি (নৌ পুলিশ) শেখ মো. মারুফ হাসান, ডিআইজি সিলেট রেঞ্জ মো. কামরুল আহসান, ডিআইজি চট্টগ্রাম রেঞ্জ খন্দকার গোলাম ফারুক, ডিআইজি খুলনা রেঞ্জ মো. দিদার আহমেদ ও ডিআইজি রাজশাহী রেঞ্জ এম খুরশিদ হোসেন। এছাড়া রয়েছেন খুলনার পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবির, ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাহবুবুর রহমান রিপন, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিআইজি, ঢাকা) মীর রেজাউল আলম, ডিআইজি (সিটি এসবি ঢাকা) মোহাম্মদ আলী মিয়া, ডিআইজি (রংপুর রেঞ্জ) দেবদাস ভট্টাচার্য, অতিরিক্ত কমিশনার (ডিআইজি ডিএমপি) কৃষ্ণপদ রায়, ডিআইজি (পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স) হাবিবুর রহমান, ডিআইজি (অপারেশন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স) আনোয়ার হোসেন, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাফিস আক্তার, ডিআইজি (ট্রেনিং) ড. খ. মহিদ উদ্দিন, অতিরিক্ত কমিশনার (ডিএমপি) আবদুল বাতেন, র্যাব-৪ এর এডিশনাল ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির, যুগ্ম কমিশনার (ডিএমপি) শেখ নাজমুল আলম, এডিশনাল ডিআইজি (খুলনা রেঞ্জ) একেএম নাহিদুল ইসলাম, এডিশনাল ডিআইজি (খুলনা রেঞ্জ) মো. মনিরুজ্জামান, এডিশনাল ডিআইজি (সিলেট রেঞ্জ) জয়দেব কুমার ভদ্র ও এডিশনাল ডিআইজি (ঢাকা রেঞ্জ) মো. আসাদুজ্জামান। এছাড়া রয়েছেন জয়েন কমিশনার (ডিবি) মাহবুব আলম, এসপি মোল্লা নজরুল ইসলাম, এসপি (ট্যুরিস্ট পুলিশ, সিলেট) আলতাফ হোসেন, ডিসি (তেজগাঁও) বিপ্লব কুমার সরকার, ডিসি ডিএমপি হারুন অর রশীদ, ডিসি রমনা মো. মারুফ হোসেন সরকার, ডিসি (সিএমপি) এসএম মেহেদী হাসান, ডিসি (ডিবি, উত্তর) খন্দকার নুরুন নবী, ডিসি (সিএমপি) মো. ফারুকুল হক, ডিসি (কাউন্টার টেরোরিজম, ডিএমপি) প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, ডিসি (ডিএমপি) এসএম মুরাদ আলী, এডিসি (ডিএমপি) শিবলী নোমান, এসপি (ঢাকা) শাহ মিজান শফি, এসপি (নায়ারণগঞ্জ) মো. আনিসুর রহমান, এসপি (মুন্সীগঞ্জ) মো. জায়েদুল আলম, এসপি (নরসিংদী) মিরাজ, এসপি (টাঙ্গাইল) সনজিত কুমার রায় ও এসপি (মাদারীপুর) সুব্রত কুমার হাওলাদার। এছাড়া তালিকায় আছেন ময়মনসিংহের এসপি শাহ আবিদ হোসেন, এসপি (শেরপুর) আশরাফুল আজিম, এসপি (সিলেট) মো. মনিরুজ্জামান, এসপি (বরিশাল) সাইফুল ইসলাম, এসপি (ভোলা) মোক্তার হোসেন, এসপি (খুলনা) এসএম শফিউল্লাহ, এসপি (সাতক্ষীরা) মো. সাজ্জাদুর রহমান, এসপি (বাগেরহাট) পঙ্কজ চন্দ্র রায়, এসপি (যশোর) মঈনুল হক, এসপি (ঝিনাইদহ) হাসানুজ্জামান, এসপি (কুষ্টিয়া) আরাফাত তানভির, এসপি (চট্টগ্রাম) নূর এ আলম মিনা, এসপি (নোয়াখালী) ইলিয়াস শরীফ, এসপি (ফেনী) এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, এসপি (কুমিল্লা) সৈয়দ নুরুল ইসলাম, এসপি (রংপুর) মিজানুর রহমান, এসপি (দিনাজপুর) সৈয়দ আবু সায়েম, এসপি (ঠাকুরগাঁও) মনিরুজ্জামান, এসপি (রাজশাহী) মো. শহিদুল্লাহ, এসপি (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) মোজাহিদুল ইসলাম, এসপি (নওগাঁ) ইকবাল হোসেন, এসপি (নাটোর) সাইফুল্লাহ, এসপি (বগুড়া) আশরাফ আলী, এসপি (সিরাজগঞ্জ) টুকুল চক্রবর্তী ও এসপি (পাবনা) রফিক ইসলাম। এ চিঠিতে বলা হয়েছে, বিগত ১০ বছর ধরে পুলিশের গুটিকয়েক কর্মকর্তা ঘুরেফিরে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন হয়েছেন। অথচ পুলিশ বিভাগের ৭০০ জন কর্মকর্তাকে পদায়নবঞ্চিত করা হয়েছে।
এছাড়া বিএনপির অপর এক চিঠিতে বলা হয়, সিটি কর্পোরেশন ও সরকারি মালিকানাধীন ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে ও বোর্ডে মন্ত্রী, এমপি ও সরকারের উন্নয়ন প্রচার বন্ধ করতে হবে। আরেক চিঠিতে নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে পুলিশের তালিকা অনুযায়ী ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ না দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।