অনলাইন ডেস্ক : রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়ায় সরকারি কোয়ার্টার থেকে মা ও দুই সন্তানের লাশ উদ্ধারের পর গত মঙ্গলবার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তবে নিষ্ঠুর এ ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি। স্বজনরা কোনো মামলা না করায় আপাতত পুলিশের পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। ঘটনাস্থলে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিহতের স্বজনের কারও কারও ধারণা, মা জেসমিন আক্তার তার দুই সন্তান হাসিবা তাসনিম হিমি (৮) ও আদিবা তাহসিন হানিকে (৫) হত্যার পর নিজে আত্মহত্যা করতে পারেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কোষাধ্যক্ষ জেসমিন মাইগ্রেনের সমস্যাসহ কিছুদিন ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। দেশে-বিদেশে তিনি চিকিৎসাও নিয়েছিলেন।

তবে লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. এএম সেলিম রেজা বলেন, আঘাতের ধরনগুলো ‘ব্যতিক্রমধর্মী’ বলে মনে হয়েছে। সাধারণভাবে আমরা যে ধরনের আলামত পাই, তার চেয়ে একটু আলাদা।

তিনি আরও বলেন, আঘাতের আগে তাদের কোনো ধরনের বিষ বা এ জাতীয় কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কি-না, এটা জানতে ভিসেরা নমুনাও সংরক্ষণ করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, আঘাতের কারণে জেসমিন আক্তার ও তার দুই মেয়ের শরীরে জখম ছিল। এই জখমের কারণে রক্তক্ষরণে তারা মারা যায়।

লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে জড়িত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নিহত তিন জনের গলা কাটা ছিল। জেসমিনের গলার পাশাপাশি দুই হাতে কবজির কাছে কাটা ছিল। বুকে ছিল কমপক্ষে ১২টি আঘাতের চিহ্ন। বড় মেয়ে হিমির পেটে তিনটি আঘাতের চিহ্ন। তার বাম হাতের কবজি কাটা ছিল। ছোট মেয়ে হানির পেটে একটি এবং ডান হাতের কবজির কাছে কাটা ছিল।

মা দুই শিশুকে হত্যার পর নিজে আত্মহত্যা করলে তার শরীরে একসঙ্গে এতগুলো আঘাত পাওয়া সম্ভব কি-না জানতে চাইলে পুলিশের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দুই বাচ্চার শরীরের আঘাত নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। তবে প্রথমে লাশ দেখার পর মায়ের শরীরে আঘাত নিয়ে তাদের মনেও সংশয় ছিল। কিন্তু নিহতের পরিবারের সদস্যরা যখন বলছিলেন জেসমিন বেশকিছু দিন ধরেই মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত ছিলেন। মাস খানেক আগে বিষ এনে দুই বাচ্চাকে ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানোর সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া ঘটনার দিন ভেতর থেকে দরজা লাগানো ছিল। অনেকবার ডাকার পরও সেটি না খোলায় জেসমিনের স্বামী জাতীয় সংসদের অ্যাসিসট্যান্ট লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান হাসিবুল ইসলাম ও তার শ্যালক দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। এরপর তারা দেখেন মেঝেতে পড়ে আছে জেসমিনের ক্ষতবিক্ষত দেহ। আর দুই শিশুর রক্তাক্ত নিথর দেহ ছিল বিছানার ওপর। আলামত ও স্বজনের বক্তব্য শুনে তারা প্রাথমিকভাবে মনে করছেন জেসমিন দুই সন্তানকে হত্যার পর নিজে আত্মহননের পথ বেছে নেন। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মানসিক ভারসাম্য না থাকার সময় এলোপাতাড়ি ছুরি চালালে যে কোনো ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম থাকতে পারে। ঘটনাস্থল থেকে একটি ছুরি উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই ধরনের ছুরি সেই বাসায় আগে দেখেননি পরিবারের সদস্যরা। এরপরও ঘটনাটি নিয়ে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।

জেসমিনের ছোট ভাই শাহিনুর রহমান বলেন, এটা কি করে সম্ভব আপা নিজের গলা ও হাত কেটে আবার পেটেও আঘাত করেছে। দুই ভাগনির গলা কাটা। শরীরেও আঘাত। কোনো কিছু বুঝতে পারছি না।

তিনি আরও বলেন, পাইকপাড়ার সি-টাইপ গভর্নমেন্ট স্টাফ কোয়ার্টারের ১৩৪ নম্বর ভবনের চতুর্থ তলার যে কক্ষ থেকে সোমবার তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে সেই কক্ষে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানোর সুযোগ নেই। ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে বাইরে বের হওয়ারও উপায় নেই। দরজা ভেঙে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনার দির অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও সাড়া না পেয়ে তাদের সন্দেহ হয়। হাসিবুল নামাজ শেষে ফিরলে দরজা ভাঙার চেষ্টা করা হয়। একপর্যায়ে দরজা কিছুটা ফাঁক করে সেখান দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বড় মেয়েকে দেখেন তিনি। তখন রড দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলা হয়। এরপর খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ।

জেসমিনের খালাত বোন রেহানা পারভীন জানান, তার বোন অনেকদিন ধরেই মাইগ্রেন ও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। দেশে-বিদেশে চিকিৎসাও চলছিল। একবার বিষ এনে সন্তানদের খাওয়ানোর চেষ্টার সময় ধরা পড়ে যান। তখন তিনি ব্যাখ্যা দেন, গাছে দেওয়ার জন্য কীটনাশক এনেছিলেন। জেসমিন নিজেকে অসুখী ভাবতেন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ক্যাশিয়ার পদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতেন। আবার বলতেন চাকরি ছেড়ে দিলে কীভাবে সংসার চলবে? এসব নিয়ে দোটানায় থাকতেন তিনি। মানসিক সমস্যা থেকেই মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা তার। তবে তাদের পারিবারিক কলহ ছিল না বলে জানান রেহানা।

মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদ আহমেদ বলেন, জেসমিন মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, সন্তানদের হত্যার পর আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন তিনি। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই সন্দেহাতীতভাবে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা যাবে।

হাসিবুলের ফেসবুক পেজে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই হাসিবুল তার দুই শিশুর ছবি পোস্ট করেন। সেখানে বাবার কর্মস্থল জাতীয় সংসদ ভবনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুই বোন। বাবার ফেসবুকজুড়ে পারিবারিক এসব ছবি এখন কেবলই স্মৃতি