ফাইল ছবি: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকারে শেখ হাসিনাকে রেখে এবং না রেখে দুইভাবেই প্রস্তাব দেওয়ার কথা ভাবছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তবে বিষয়টি নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে কিছুটা দ্বিমত আছে। কারণ ফ্রন্টের একটি অংশ মনে করছে, সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে সরানোর প্রস্তাব দিলে তিনি বিগড়ে যাবেন। ওই পরিস্থিতিতে দাবির কিছুই আদায় করা যাবে না। আবার অপর একটি অংশের মত, সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে মেনে নিলে বিএনপির প্রাধান্য থাকা জোটের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ওই অংশটি শেখ হাসিনার বদলে প্রয়োজনে আওয়ামী লীগেরই অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেওয়ার পক্ষে, যেহেতু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁদেরই। এমন পরিস্থিতিতে আগামীকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপের আগে প্রস্তাবটি আরো ভেবেচিন্তে দিতে চায় ঐক্যফ্রন্ট।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, এসংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরির জন্য গত রবিবার অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কমিটিতে এমন দুই ধরনের মতামত উঠে আসে। যদিও শেষ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির খসড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেখেই তৈরি করা হয়, যেখানে বিএনপিরসহ ঐক্যফ্রন্টের কয়েকজন নেতাও উপস্থিত ছিলেন। খসড়াটি আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের চেম্বারে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
খসড়ায় জোরালোভাবে তিনটি দাবি তুলে ধরার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমত, সংসদ ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ভোটগ্রহণ। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট কোটায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা সংসদের বাইরের বিরোধী দলগুলো থেকে মন্ত্রী করে তাঁদের স্বরাষ্ট্র বা জনপ্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেওয়া এবং তৃতীয়ত, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি ও তাঁর ভোটে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সাজা স্থগিত করা। আদালতে সরকারপক্ষ খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা না করলে জামিন পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। তবে এ প্রশ্নে সমঝোতা লাগবে। আর এ জন্যই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে রেখে সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি তুলছেন তাঁরা।
তবে একই বৈঠকে ঐক্যফ্রন্টের একটি দলের দুই নেতা প্রস্তাব করেন যে সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় ইচ্ছা করলে শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয়ই অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী করা যায়। ওই প্রস্তাব ফ্রন্টের অপর একটি দলের নেতা সমর্থন করেন। তবে উপস্থিত অপর দুজন নেতা এ সময় বলেন, শেখ হাসিনাকে সরানোর উদ্যোগ নিলে তিনি বিগড়ে যেতে পারেন। এ অবস্থায় বিষয়টি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মতিঝিলে স্টিয়ারিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়।
তবে সংসদ ভেঙে নির্বাচন দিলে নিরপেক্ষ সরকারের দাবির বিষয়ে ঐক্যফ্রন্ট অনড় থাকবে না—এমন আলোচনাও আছে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মধ্যে।
জানতে চাইলে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে রেখে এবং না রেখে দুই ধরনের প্রস্তাবের কথাই আলোচনা হচ্ছে। তবে এখনই চূড়ান্ত কিছু নয়। সংলাপের আগে এ বিষয়ে অনেক আলোচনা হবে, জানান তিনি।
নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংবিধানের মধ্যে থেকেই প্রধানমন্ত্রীকে একটি প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলে আসছেন ঐক্যফ্রন্টের প্রবীণ নেতা ড. কামাল হোসেন। সে অনুযায়ী একটি প্রস্তাব তৈরি হচ্ছে। প্রস্তাব তৈরিতে রবিবারের বৈঠকে বিএনপির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ছাড়াও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, ড. বোরহান আহমেদ, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, ঐক্যপ্রক্রিয়ার সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, গণফোরাম নেতা সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ উপিস্থিত ছিলেন। গতকাল দুপুরে ওই খসড়া প্রস্তাব নিয়ে কামাল হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. শাহদীন মালিক ও আসিফ নজরুল। এরপর সন্ধ্যায় বসে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক।
জানতে চাইলে ড. আসিফ নজরুল কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামোর প্রশ্নে সংবিধানের মধ্যে থেকে কী কী করা যায় সে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের কথাও জানান তিনি।
ঐক্যফ্রন্ট নেতারা কালের কণ্ঠকে জানান, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের কথা সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। আর সংসদ ভেঙে দিলে বর্তমান সরকারই অন্তর্বর্তী সময়ে দায়িত্ব পালন করবে। সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রিসভার সদস্যদের এক-দশমাংশ টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী রাখা যায়। বর্তমান মন্ত্রিসভায় ৫০ জনের মতো সদস্য আছেন। অর্থাৎ পাঁচজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী রাখা সম্ভব। এই মন্ত্রীদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা বিরোধীদের থেকে নেওয়া হলে এবং তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
ফ্রন্ট নেতারা মনে করেন, সমঝোতা হলে বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়টিও কোনো সমস্যা নয়। কারণ রাষ্ট্রপক্ষ যদি তাঁর জামিনের বিরোধিতা না করে বা আপিলে সাজা স্থগিতের বিরোধিতা না করে, তাহলে ভোটের সময় খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব এবং এভাবে নির্বাচনে তাঁর অংশগ্রহণও নিশ্চিত হয়। আর এটা চাওয়া অন্যায্য কিছু নয়।
গত ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম দফা সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে সাত দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, আলোচনা সাপেক্ষে নিরপেক্ষ সরকার গঠন, খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দেওয়া; বাক্, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, সামাজিক গণমাধ্যমে মত প্রকাশের অভিযোগে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা; নির্বাচনের ১০ দিন আগে থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া—এসব দাবিও ছিল সাত দফায়।
তবে সংলাপে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং সম্পূর্ণ নির্বাচনপ্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে তাঁদের ওপর কোনো ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ না করা, তালিকা দিলে রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা এবং নতুন কোনো মামলা না দেওয়ার নিশ্চয়তা এবং সভা-সমাবেশে বাধা না দেওয়ার আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী।
আগামী ৭ নভেম্বর সকালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের দিন এ বিষয়ে তিনি নিজেই সংবাদ সম্মেলন করে জানাবেন—এমন কথা রয়েছে। তথ্যসূত্র: