দর্পণ ডেস্ক : শুক্রবার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো শারদীয় দুর্গোৎসব। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ চোখের জলে বিদায় দিয়েছেন জগজ্জননী মা দেবী দুর্গাকে। সেই সঙ্গে আসছে বছর আবারও এই মর্ত্যলোকে ফিরে আসবেন মা- এই আকুল প্রার্থনাও জানিয়েছেন তারা।

অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ-কল্যাণ ও সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে নিরন্তর শান্তি-সম্প্রীতির আকাঙ্খা নিয়ে বৃহস্পতিবার ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে এই উৎসব শুরু হয়েছিল।

সনাতন বিশ্বাস ও পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার ঘোটকে (ঘোড়া) চড়ে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) এসেছিলেন (আগমন)। যার ফল হচ্ছে ফসল ও শস্যহানি। দেবী স্বর্গালোকে বিদায় নেন (গমন) দোলায় (পালকি) চড়ে। যার ফল হচ্ছে মড়ক।

বিজয়া দশমী উপলক্ষে শুক্রবার ছিল সরকারি ছুটি। সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।

দেবী বিসর্জনের দিনটিতে বিষাদের পাশাপাশি উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ। হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উৎসবে যোগ দিয়েছেন অন্যান্য ধর্মের মানুষও।

এবার ঢাকা মহানগরীর ২৩৪টিসহ সারাদেশে ৩১ হাজার ২৭২টি পূজামণ্ডপে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনসহ বিভিন্ন পূজামণ্ডপে বসেছে মেলা। পূজা শেষ হলেও কোথাও কোথাও এ মেলা আরও দু’তিন চলবে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন।

পাঁচদিনের শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষদিনের মূল আকর্ষণ বিজয়া শোভাযাত্রা ও প্রতিমা বিসর্জন। বিকেল ৪টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনের কেন্দ্রীয় পূজামণ্ডপ প্রাঙ্গণ থেকে একযোগে শুরু হয় বর্ণিল শোভাযাত্রা। দুপুর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পূজামণ্ডপ থেকে পূজারীরা ট্রাক ও ঠেলাগাড়িতে করে প্রতিমা নিয়ে সমবেত হন মন্দির মেলাঙ্গনে। সেখানে ভক্তদের নাচ-গানে মুখর হয়ে উঠে চারপাশ। তারা রঙ ছিটিয়ে ও ঢাক-ঢোলসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি উলুধ্বনিতে উৎসবমুখর করে তোলেন পরিবেশ।

ঢাকেশ্বরী মন্দির পূজামণ্ডপ থেকে রাজঘট ও নবপত্রিকা (কলা বউ) নিয়ে আসার পর শুরু হয় শোভাযাত্রা। পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটিসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের নেতৃত্বে শোভাযাত্রায় ট্রাকবাহী প্রতিমাসহ বিচিত্র সাজ পোশাকে সজ্জিত নারী-পুরুষ, শিশু, কিশোর ও যুবকরা হেঁটে ও বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে যোগ দেন। অনেকেই দুর্গা, শিব ও মহিষাষুরসহ পৌরাণিক চরিত্রের নানা সাজে অংশ নেন। যাত্রাপথে রাস্তার দু’পাশে এবং আশপাশের ভবনের ছাদ-বারান্দায় দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ শোভাযাত্রাকে স্বাগত জানান।

ঢাকেশ্বরী থেকে শুরু হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পেরিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দোয়েল চত্ত্বর, জাতীয় প্রেস ক্লাব, মুক্তাঙ্গন, শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার, গোলাপশাহ মাজার, গুলিস্তান হল, নবাবপুর, বাহাদুর শাহ পার্ক ও স্টার সিনেমা হল হয়ে বুড়িগঙ্গার ওয়াইজঘাটে গিয়ে পৌঁছে। সেখানে ‘দুর্গা মায় কী জয়’, ‘আসছে বছর আবার হবে’ ইত্যাদি ধ্বনি ও উৎসবমুখর পরিবেশে প্রতিমা বহনকারী নৌকাগুলো মাঝনদীতে গিয়ে বিসর্জন দেয় প্রতিমা। বিসর্জন শেষে শান্তিজল গ্রহণ এবং হিন্দুদের ঘরে ঘরে শুভেচ্ছা বিনিময় ও মিষ্টি বিতরণ হয়েছে।

প্রতিমা বিসর্জনের আগে দিনব্যাপী নানা পূজা-অর্চনা চলে। সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় দশমীবিহিত পূজা ও দর্পণ বিসর্জন। চলে ভক্তদের আরতি আর রঙের হোলি খেলা। পরম ভক্তি নিয়ে নিজ নিজ মনের বাসনা জানিয়ে দেবীর পায়ে সিঁদুর ছোঁয়ান নারীরা। এরপর বিসর্জনের জন্য সধবা নারীরা দেবীকে সাজান ফুল, সিঁদুর ও নানা অলঙ্কার দিয়ে। পুরোহিতরা দেবীর জন্য সাজান সেদ্ধ চালের নৈবেদ্য, কচু-ঘেচু, শাপলা দিয়ে। এরপর শেষ মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে বিদায় জানানো হয় দেবীকে।

বিজয়া দশমীকে ঘিরে রাজধানীতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিপুলসংখ্যক পুলিশ-বিজিবি সদস্যের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় র ‌্যাব ও গোয়েন্দা সদস্যদের। নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ছিল ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির থেকে শোভাযাত্রার দু’পাশসহ ওয়াইজঘাট পর্যন্ত। দুপুর থেকেই পলাশীর মোড়ের চারপাশে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।

আমিনুর