দর্পণ ডেস্ক : দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, সব দলের অংশগ্রহণে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিসহ ৭ দফা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১২ দফা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘোষণা করেছে বিএনপি। রোববার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভা থেকে এসব দাবি ও লক্ষ্য ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই সঙ্গে জনসভা থেকে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই ৭ দফা দাবি আদায়ে আগামী ৩ অক্টোবর বুধবার সারাদেশে জেলা পর্যায়ে সমাবেশ ও জেলা প্রশাসকদের স্মারকলিপি এবং ৪ অক্টোবর বিভাগীয় শহরে সমাবেশ ও বিভাগীয় কমিশনারদের স্মারকলিপি প্রদানের দু’দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে দলটি।

দুই দফা পিছিয়ে এবং পাল্টাপাল্টি সমাবেশ এড়িয়ে ২২ শর্তে অনুমতি পেয়ে ২৪ ঘণ্টার প্রস্তুতিতে এ জনসভা করে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মামলা প্রত্যাহার এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে এ জনসভা করে দলটি। জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ব্যানারে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার নাম এবং মঞ্চের মাঝে তার জন্য একটি শূন্য চেয়ার রাখা হয়। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে জনসভায় প্রধান বক্তা ছিলেন স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। জনসভায় বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগী শীর্ষ নেতা এবং ২০ দলীয় জোটের শরিক কোনো দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া অত্যন্ত জরুরি মনে করে বিএনপি। জনসভায় এ লক্ষ্যে আগামী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই পূরণের জন্য ৭ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়।

দাবিগুলো হলো- ১. খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি এবং তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, ২. জাতীয় সংসদ বাতিল করা, ৩. সরকারের পদত্যাগ ও সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা, ৪. যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার বিষয়ে নিশ্চিত করা, ৫. সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ নিশ্চিত করা, ৬. নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে তাদের ওপর কোনো প্রকার বিধিনিষেধ আরোপ না করা, ৭. (ক) দেশের বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তি, সাজা বাতিল ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, (খ) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনী ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও নতুন কোনো ধরনের মামলা না দেয়ার নিশ্চয়তা, (গ) পুরনো মামলায় কাউকে গ্রেফতার না করার নিশ্চয়তা, (ঘ) কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সাংবাদিকদের আন্দোলন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে স্বাধীন মতপ্রকাশের অভিযোগে ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির নিশ্চয়তা।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১২ লক্ষ্য ঘোষণা : জনসভায় নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১২টি লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এসব লক্ষ্য হচ্ছে- ১. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি ন্যায়ভিত্তিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করা; ২. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলীয়করণের ধারার বদলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা; ৩. রাষ্ট্র ক্ষমতায় গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা; ৪. স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা; ৫. স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে আরও আধুনিক, শক্তিশালী ও কার্যকর করা; ৬. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; ৭. কঠোর হস্তে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও অধিকতর কার্যকর করা; ৮. সকল নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা; ৯. ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এই মূলনীতিকে অনুসরণ করে জাতীয় মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণ করে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক এবং সৎ প্রতিবেশী সুলভ বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, বিনিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা; ১০. কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় না দেয়া এবং কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেয়া; ১১. নিম্ন আয়ের নাগরিকদের মানবিক জীবনমান নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গতিপূর্ণ বেতন-মজুরি নির্ধারণসহ বিভিন্ন দাবি, ১২. সকল প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসানে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করতে ড. কামাল হোসেন ও বি. চৌধুরীর সঙ্গে যৌথ আন্দোলনের তোড়জোড়ের মধ্যে বিএনপির উত্থাপিত ৭ দফা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ৫ দফারই অনুরূপ। শুধু বিএনপির প্রথম দফায় দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি যোগ করেছে বিএনপি। সেই সঙ্গে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মুক্তভাবে কাজ করতে দেয়ার একটি দফা যোগ করেছে বিএনপি।

দুপুর ২টায় জনসভা শুরুর কথা থাকলেও সকাল ১০টা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী-সমর্থকরা মিছিল নিয়ে আসতে থাকেন। এ সময় নেতাকর্মীদের হাতে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রতিকৃতি সংবলিত পোস্টার দেখা যায়। জনসভায় আসা নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ নানা স্লোগানে মুখর করে তুলে পুরো এলাকা।

জনসভায় আওয়ামী লীগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সারাদেশে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি ও ভৌতিক মামলা দেয়া হচ্ছে। পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আপনারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করুন। ক্ষমতার পরিবর্তন হলে এসব মামলার জন্য সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে। কেউ রেহাই পাবেন না। এমনকি আওয়ামী লীগও রেহাই পাবে না।

সরকারের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই সরকার মেগা প্রজেক্টের নামে লুটপাট করছে। দেশের ব্যবসায়ীরা কর ও চাঁদা দিতে দিতে অস্থির হয়ে পড়েছে। এই সরকার দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এজন্য দেশ ও জনগণকে রক্ষার জন্য একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে আবারও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সব দলমত এক হয়ে এই ভয়ঙ্কর শক্তিকে সরানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

গণতন্ত্র উদ্ধারে কারাবন্দি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত রয়েছেন বলেও বার্তা পাঠানোর কথা জানান মির্জা ফখরুল।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আওয়ামী লীগ আতঙ্কিত বলে প্রতিদিন আবোলতাবোল বলছে। এ সময়ে আওয়ামী লীগকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, বিএনপি কোনো প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না।

স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটা জঘন্যতম আইন। এই আইনকে রুখে দেওয়ার জন্য আজ গণমাধ্যম কর্মীদেরও সোচ্চার হতে হবে। এই আইনে স্বাধীনতা-পরবর্তী রক্ষী বাহিনীর থেকেও ভয়াবহভাবে পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে তিনি ঘোষণা করেন, আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সাত দিনের মধ্যে এই কালো আইন বাতিল করা হবে।

ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেছেন, জনসভার মধ্য দিয়ে আন্দোলনের যে সূচনা হয়েছে, তা ত্বরান্বিত করে এই সরকারের পতন ঘটাতে হবে। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, আন্দোলনে নামুন, রাস্তায় থাকুন। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে।

মির্জা আব্বাস বলেছেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে এখন আদালত হচ্ছে স্কুলে যাওয়ার মতো ঘটনা। এমন কোনো নেতাকর্মী নেই, যার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়নি। এখন পুলিশ গায়েবি মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মী খেদাও কর্মসূচি পালন করছে।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপি সব সময়ে জাতীয় ঐক্য চেয়েছে। গণতন্ত্র ও খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনে যারাই আসবে তারাই বিএনপির বন্ধু। সে যদি শয়তানও হয়, তাতেও সমস্যা নেই।

ড. আবদুল মঈন খান বলেছেন, সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে আওয়ামী লীগকে একঘরে করে দিতে হবে। গণতান্ত্রিক এই শক্তিই একদিন দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে।

নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, রাজপথে থাকতে পারলে এই সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে, দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে, খালেদা জিয়া আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন।

দলের প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী ও ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালামের পরিচালনায় জনসভায় ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এজেডএম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, শওকত মাহমুদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, জয়নুল আবদিন ফারুক, ফজলুর রহমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবউদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

দু’দিন সাপ্তাহিক বন্ধের পর অফিস খোলার শুরুর দিন বিএনপির জনসভাকে কেন্দ্র করে রাজধানীজুড়ে যানজটে নাকাল হতে হয়েছে নগরবাসীকে। শাহবাগ ও মৎস্য ভবন এলাকায় দীর্ঘ সময়ে জটে আটকা গাড়িতে অপেক্ষার পর লোকজনকে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। বিএনপির এই জনসভাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশ পথ ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কে পুলিশকে তল্লাশি করতে দেখা গেছে। এ সময় মহানগর উত্তর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল রহমানসহ বেশ কিছু নেতাকর্মীকে পুলিশের প্রিজন ভ্যানে তুলে নিতে দেখা যায়। এছাড়া রোববারের কর্মসূচিতে পুলিশের মধ্যে মোটামুটি নমনীয় ভাব দেখা গেছে। সার্বিকভাবে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শেষ হয়েছে বিএনপির সমাবেশ।