অনলাইন ডেস্ক : ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলায় কেঁপে উঠেছিল সারাদেশ। ওই দিন ৬৩ জেলায় একযোগে ৫৫৯টি বোমা বিস্ম্ফোরিত হয়। একসঙ্গে এত বোমা তৈরির নেপথ্যে যে মূল ভূমিকা পালন করেছিল, তার নাম মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজান ওরফে মুন্না ওরফে কাওসার। সে মূলত পুরনো জেএমবির বোমা তৈরির মূল কারিগর। তার হাত ধরেই দেশে উগ্রপন্থিদের মধ্যে বোমা তৈরির হাতেখড়ি হয়। জঙ্গিরা ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) তৈরির দীক্ষাও পায় বোমা মিজানের কাছে। তাই উগ্রপন্থিদের কাছে সে ‘বোমা মিজান’ হিসেবে পরিচিত।

পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমানের অত্যন্ত কাছের লোক ছিল সে। শায়খ রহমানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর জেএমবির হাল ধরতে বারবার এগিয়ে যায় বোমা মিজান। সর্বশেষ ২০১৪ সালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা করে জেএমবির সদস্যরা বোমা মিজান, সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি ও রাকিবুলকে ছিনিয়ে নেয়। পরে রাকিবুল পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। আর বোমা মিজান ও সালেহীন ভারতে পালিয়ে যায়।

জঙ্গিদের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখা পুলিশ-র‌্যাবের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা সমকালকে জানান, বর্তমানে ভারতে সক্রিয় পুরনো জেএমবির দুটি গ্রুপের মধ্যে একাংশের আমির বোমা মিজান। আরেক অংশের আমির সালেহীন। মূলত সেখানে অবস্থানকালে বোমা মিজান ও সালেহীনের মধ্যে সংগঠনের কিছু ব্যাপার নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। জেএমবির ভারতীয় শাখা দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বোমা মিজানের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার ঘিরে জেএমবির একটি বড় বলয় তৈরি করা। ২০১৩ সালের দিকে তামিম চৌধুরীর হাত ধরে দেশে নব্য জেএমবি সক্রিয় হলেও বোমা মিজান সেখানে যোগ দেয়নি। অর্থের লোভে পুরনো জেএমবির অনেকে তামিমের সঙ্গে যুক্ত হলেও বোমা মিজান ছিল অনড়। দেশে ফিরে পুরনো জেএমবিকে চাঙ্গা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ভারতেই জেএমবিকে সক্রিয় করার কাজে হাত দেয় বোমা মিজান। একে একে খাগড়াগড় ও বুদ্ধগয়ায় বিস্ম্ফোরণে মূল ভূমিকা পালন করে সে।

জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে এক দশকের বেশি সময় কাজ করছেন এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা গতকাল সমকালকে জানান, পশ্চিমবঙ্গের জেএমবির সদস্যরা বাংলাদেশের জেএমবিকে অনুকরণ করে থাকে। জেএমবির মূল আমির মাওলানা সাইদুর রহমান বিভিন্ন সময় গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, জেএমবির পশ্চিমবঙ্গে একটি শাখা রয়েছে। তবে ওই শাখায় রয়েছে ভারতের নাগরিকরা। বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদে জেএমবি শক্ত অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছে। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গিবাদবিরোধী কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়। এরপর জেএমবিসহ অনেক জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে।

২০০৯ সালের ১৫ মে রাজধানীর কাফরুলের তালতলা থেকে বোমা মিজানকে গ্রেফতার করে র?্যাব। পরে তার মিরপুরের বাসা থেকে বোমা, বিস্ম্ফোরকসহ স্ত্রী হালিমাকেও র?্যাব গ্রেফতার করে। ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত কারাগারে ছিল বোমা মিজান। মূলত প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে জেএমবি নতুনভাবে তাদের শক্তি জানান দেয়। ওই ঘটনার পর রাকিবুল আটক হলেও সানি ও মিজানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মূলত ভারতে পলাতক থেকেই তারা সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহ করতে থাকে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতের জেএমবির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করলেও দুই দেশের জন্য সাংগঠনিক কাঠামো আলাদা। আল কায়দা ও আইএসের মতো একই নেতৃত্বের ব্যানারে তারা কাজ করে না। তবে তাদের আদর্শ এক ও অভিন্ন।

জানা গেছে, ত্রিশালে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় জেএমবির শীর্ষ নেতা ফারুকের নেতৃত্বে ছিল শফিক, জাকারিয়া, মাজিদ, মিলন ও সবুজ। তারা মহাসড়কের কোন পয়েন্ট থেকে প্রিজনভ্যানে হামলা চালালে সুবিধা হবে, তার একাধিক জায়গা ঠিক করে। অপারেশনের পর ফারুকের নেতৃত্বে জেএমবির একটি দল ফের ভারতে চলে যায়।

জানা গেছে, ‘বাংলাভাই ও শায়খ আবদুর রহমান’ যুগে ফিরতে নতুন পরিকল্পনা করছিল জেএমবি। এর মূল চরিত্রে ছিল বোমা মিজান ও সালেহীন। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জে প্রকাশক ও লেখক শাহজাহান বাচ্চু হত্যার মধ্য দিয়ে পুরনো জেএমবি নতুনভাবে সক্রিয় হওয়ার বিষয়টি জানান দেয়। তারা দেশে ডাকাতি ও চুরিতে জড়ায়। সেখান থেকে পাওয়া অর্থ সংগঠনে ব্যয় করে।

পুরনো জেএমবির বাংলাদেশ ও ভারতে সক্রিয় তিনটি ধারার নেতৃত্বে রয়েছে পলাতক জঙ্গি সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি, বোমা মিজান ও দেশে কারাবন্দি সাইদুর রহমান। পুরনো জেএমবি এখনও মনে করছে, তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে নব্য জেএমবি যে আদর্শ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল, তা ভুল ছিল। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে নব্য জেএমবির পতন হয়।

গোয়েন্দারা এটাও বলছেন, প্রকাশক বাচ্চু হত্যার ঘটনায় পুরনো জেএমবির সংশ্নিষ্টতার আলামত এটা প্রমাণ করছে- হত্যা মিশন সফল করার মতো অবস্থায় আবার পৌঁছেছে জঙ্গিরা।

১৯৯৮ সালে শায়খ আবদুর রহমানের হাত ধরে জেএমবি প্রতিষ্ঠা করার পর ২০০১ সালে সংগঠনটি প্রথম হামলা চালায়। ২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রক্সি সিনেমা হল ও সার্কাস মাঠে বোমা হামলা চালায় তারা। এরপর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অন্তত ৪০টি হামলায় জড়িত ছিল জেএমবি। এসব হামলায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। পুরনো জেএমবি বিভিন্ন সময় যত বোমা হামলা করেছিল, সবক’টিতে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত ছিল বোমা মিজান ও তার সাঙ্গপাঙ্গ