অনলাইন ডেস্ক :

রাজধানী ঢাকায় শব্দ দুষনের মাত্রা বিপৎজনক মাত্রায় বেড়ে গেছে। সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য যা সবচেয়ে বড় হুমকি।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ঢাকা মহানগরীর ৪৫টি স্থানের শব্দ দূষণের মাত্রা পরিমাপ করে দেখেছে, ঢাকা শহরে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে শব্দের মাত্রা স্বাভাবিক আছে। গত বছরের জানুয়ারিতে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপকৃত স্থানগুলো নীরব, আবাসিক, মিশ্র ও বাণিজ্যিক এলাকা। নীরব এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা ৮৩.৩ থেকে ১০৪.৪ ডেসিবল। আবাসিক এলাকায় দিনে ৯২.২ থেকে ৯৭.৮ ডেসিবল এবং রাতে ৬৮.৭ থেকে ৮৩.৬ ডেসিবল। মিশ্র এলাকায় দিনে ৮৫.৭ থেকে ১০৫.৫ ডেসিবল এবং রাতে ৮৫.৭ থেকে ১০৬.৪ ডেসিবল। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা ৯৪.৩ থেকে ১০৮.৯ ডেসিবল।

ছোট্ট লিমন ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। গত কয়েকদিন ধরে সে স্কুলে যেতে পারছে না। তার কানের ভেতর শো-শো শব্দ করছে, সাথে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। অভিভাবকরা চিকিত্সকের কাছে নিয়ে গেলে চিকিত্সক জানান, রাস্তায় গাড়ির কড়া শব্দের হর্ণে লিমনের কানের পর্দা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় কানে কম শুনছে।

শুধু ছোট্ট লিমন নয়, সব বয়সের মানুষই মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। রাজধানীর পাশাপাশি সারাদেশেই শব্দদূষণের মাত্রা দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

চিকিত্সকরা বলছেন, শব্দদূষণের বর্তমান যে চিত্র, তা বিপজ্জনক মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। নীরব ঘাতক এ শব্দদূষণের কারণে মেজাজ খিটখিটে, উৎকণ্ঠা, মানসিক অস্থিরতা, উচ্চ রক্তচাপ, ঘুম না হওয়া ও এক ধরনের শব্দভীতি তৈরি হয়। দীর্ঘদিনের শব্দদূষণের ফলে কেউ কেউ পুরোপুরি বধিরও হয়ে যেতে পারেন। এমনকি উচ্চ মাত্রার শব্দের কারণে হূদরোগীর রক্তচাপ ও হূত্কম্পন বেড়ে গিয়ে মৃত্যুঝুঁকিও হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবল শব্দে সাময়িকভাবে শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে। আর ১০০ ডেসিবলে চিরতরে তা হারাতে হতে পারে। অথচ রাজধানী ঢাকার অনেক জায়গাতেই শব্দ ১০৭ ডেসিবল পর্যন্ত ওঠে।

শব্দ দূষণের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শহরকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে- নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা। এসব এলাকায় দিন ও রাত ভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিধি অনুযায়ী শব্দের মানমাত্রা নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ও রাতে ৪৫ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ ডেসিবল।

এই আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা চিহ্নিত করা হয়। এসব জায়গায় মোটরগাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু রাজধানীতে কোথায় শব্দের মাত্রা স্বাভাবিক নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক, কান ও গলা বিভাগ কর্তৃক ২০১৩ সালে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এক-তৃতীয়াংশ লোক কোন না কোন শ্রুতিক্ষীণতায় ভুগছেন এবং ৯ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রুতি প্রতিবন্ধী। একই সঙ্গে দেশে ১৫ বছর বয়সের নিচের জনসংখ্যার মধ্যে শ্রুতি প্রতিবন্ধীর হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, শব্দ দূষণের বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা মহানগরীর ৫০ শতাংশ মানুষ ৩০ ডেসিবল শব্দ শোনার ক্ষমতা হারাবে, শিশুদের মধ্যে বধিরতার হার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে এবং তারা লেখাপড়ায় অমনোযোগী ও বিকার মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে।
গবেষণায় দেখা যায়, ঘুম, রক্তচাপ এবং হজমের ক্ষেত্রে শারীরিক যে পরিবর্তন ঘটে তা শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং ভ্রূণের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের ক্ষেত্রেও শব্দের সংযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে সব কারণে ঘুমের ব্যাঘাত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো শব্দ। যখন ঘুমের ব্যাঘাত ক্রমবর্ধমান হয় তখন স্বাস্থ্যের ওপর বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার ৭০টি পয়েন্টে দিনের বেলা শব্দ ৯৯.৬ থেকে ১৩০.২ ডেসিবল এবং রাতে ৪৩.৭ থেকে ৬৫.৭ ডেসিবল। ফার্মগেইটে দিনের বেলা শব্দ ১৩০.২ ডেসিবল এবং রাতে ৬৫.৭ ডেসিবল। গাবতলী, আরামবাগ, গুলশান-২, গুলিস্তান, মিরপুর ১০, বাংলামটর, নিউমার্কেট, উত্তরা মাসকাট প্লাজা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দিনের বেলা শব্দ ১২০ ডেসিবলের উপরে। উত্তরা ১৪ নং সেক্টরে দিনের বেলা শব্দ ৯৯.৬ ডেসিবল এবং রাতে ৪৩.৭ ডেসিবল ।

এই অধিক শব্দের মাত্রা মানুষের শারীরের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। ঢাকা শহরে চলাচলকারী লোকজনের মধ্যে যে অসহিষ্ণুতা এবং বদমেজাজ দেখা যায়, তার সঙ্গে এই শহরের ভয়ঙ্কর মাত্রার শব্দদূষণের একটি কার্যকর সম্পর্ক রয়েছে।

রাজধানীর বাইরের চিত্র
রাজধানীর বাইরেও শব্দদূষণের চিত্র ভয়াবহ। রাজশাহীর ভদ্রার মোড় এলাকায় দূষণের সর্বোচ্চ মাত্রা ১৩২ দশমিক ৮ ডেসিবল, যা ঢাকার চেয়েও বেশি। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ এলাকায় শব্দদূষণের সর্বোচ্চ মাত্রা ৯৫ দশমিক ৫ ডেসিবেল। অন্যান্য বিভাগীয় শহরের মধ্যে চট্টগ্রামের ইপিজেড মোড় এলাকায় সর্বোচ্চ ১৩০ দশমিক ৬, পোর্ট কলোনী মোড়ে সর্বোচ্চ ৯৯ দশমিক ৩, সিলেটের করিমউল্লাহ মার্কেট এলাকায় সর্বোচ্চ ১৩০ দশমিক ৬, কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় সর্বোচ্চ ৮১ দশমিক ৮, খুলনার নিউমার্কেট এলাকায় সর্বোচ্চ ১২৮ দশমিক ৯, বরিশালের কাশিমপুর বাজার এলাকায় সর্বোচ্চ ১৩১ দশমিক ৩, বরিশাল জিলা স্কুল এলাকায় সর্বোচ্চ ১২২ দশমিক ৩, রংপুরের বাস টার্মিনাল এলাকায় সর্বোচ্চ ১৩০ দশমিক ১, ময়মনসিংহের ধোপাখোলা মোড় এলাকায় ১২৯ দশমিক ৯, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় সর্বোচ্চ ৮৭ দশমিক ৭ ডেসিবেল।

শব্দদূষণের কারণ
মোটরযানের হর্ন শব্দদূষণের অন্যতম কারণ? যানজটে ধৈর্য হারানো, সিগন্যাল ছাড়ার পর সামনের গাড়ি চালু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করা, বেপরোভাবে গাড়ি চালানো, অপ্রয়োজনে হর্ন বাজানো, মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার, ইটভাঙার মেশিনের শব্দ ও নির্মাণ কাজে ব্যবহূত যন্ত্রপাতির শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, কলকারখানার সৃষ্ট শব্দ, রাজনৈতিক, সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে মাইকের শব্দসহ বিভিন্ন কারণে শব্দদূষণ তৈরি হচ্ছে।

মেধাহীন জাতি তৈরি হবে
জাতীয় নাক-কান-গলা (ইএনটি) ইনস্টিটিউট এর অধ্যাপক বিশিষ্ট চিকিত্সক ডা. আবু হানিফ গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, শব্দদূষণ একটি নিরব ঘাতক। শব্দদূষণের বিভিন্ন কারণের মধ্যে এখন অন্যতম কারণ মোবাইল ফোন। প্রতিদিন হাসপাতালে শত শত রোগী আসছে শব্দদূষণজনিত সমস্যা নিয়ে। শব্দদূষণে শুধু যে শ্রবণশক্তির ক্ষতি হচ্ছে তাই নয় আমাদের ব্রেনের ওপর যে প্রেসার পড়ে তাতে মেধা হ্রাস পায়। বর্তমানে শব্দদূষণ এমন পর্যায়ে গেছে যে আমরা একটি মেধাহীন জাতিতে পরিণত হব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শব্দদূষণে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। রাস্তার পাশের বাড়িগুলোর মানুষ রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না। বিশেষ করে যেসব শিশুদের কেবল শ্রবণইন্দ্রিয় তৈরি হচ্ছে শব্দদূষণে তা ঠিকভাবে গঠিত হয় না। তিনি বলেন, হাইকোর্ট হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে যে রায় দিয়েছেন, তা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে। গাড়ির মালিক, চালক সবাইকে সচেতন হতে হবে। সবার সচেতনতাই পারে এ সমস্যা সমাধান করতে।

কে শোনে কার কথা!
শব্দদূষণরোধে দেশে যে বিদ্যমান আইন রয়েছে তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। আইন অমান্য করলে প্রথমবারের অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে? এছাড়া অপ্রয়োজনে হর্ন বাজালে মোটরযান অধ্যাদেশের আওতায় ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম ইত্তেফাককে বলেন, শব্দ দূষণের বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। শব্দদূষণকারীকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। তবে এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকেও আরো সচেতন হতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, আমরা যারা শব্দদূষণের সৃষ্টি করছি তারাও এর ক্ষতির শিকার। সবাই মিলে শব্দদূষণ প্রতিরোধ করতে হবে। শব্দ দূষণের উত্সসমূহ বন্ধ করার পাশাপাশি আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, আগামী প্রজন্মের সুষ্ঠু বিকাশ ও নগরবাসীর সুষ্ঠু জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে উচ্চ মাত্রার শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।