গনেশ চন্দ্র হাওলাদার

করোনা মহামারি বিশ্বব্যাপী মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রায় ব্যাপকমাত্রায় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। মানবসভ্যতা ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এতটাই উৎকর্ষ লাভ করেছে যে, পৃথিবীতে নিজেদের সব ধরনের সমস্যার প্রয়োজনীয় সমাধান বা প্রতিরোধক তৈরি করে মহাবিশ্বের অন্য গ্রহ-উপগ্রহ মানুষ জয় করতে সক্ষম হচ্ছে। সে রকম একটা সময়ে মানুষ যা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি গত ১৫ মাস ধরে তেমনই অঘটন ঘটিয়ে চলছে করোনাভাইরাস নামক অতিক্ষুদ্র একটা বস্তু, এরই মধ্যে দানবীয় নির্মমতায় প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে আক্রান্ত করেছে প্রায় ১৭ কোটি মানুষকে আর বিশ্বের ৮০০ কোটি মানুষকেই মৃত্যুভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনের সব কর্মকান্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থবির হয়ে কিংবা পরিবর্তিত হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার বাধ্যবাধকতায় নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এমনকি দীর্ঘদিন একই ঘরে কিংবা বাড়িতে থাকতে বাধ্য হওয়ায় মানসিক স্বাস্থ্য ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে কোভিড-১৯-এর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়া কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত নিশ্চয়তা দিতে না পারায় মানসিক সমস্যা যে দিন দিন আরো প্রকট হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার ওপরই মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্য এবং অন্য সব কাজের সফলতা নির্ভর করে বিধায় এ সমস্যার প্রচলিত প্রতিকারের উপায়সমূহ নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে ও জানতে হবে। একই সঙ্গে করোনা মহামারি দীর্ঘতর হতে পারে বিবেচনায় মাসসিক স্বাস্থ্যরক্ষার আরো ভালো উপায় সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের গবেষণার মাধ্যমে বের করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেছেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মহামারির প্রভাব এরই মধ্যে মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকা, সংক্রমণভীতি, পরিবারের সদস্য হারানোর দুঃখ-কষ্ট এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উপার্জন ও চাকরি হারানোর ভয়।’ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা কিংবা এর ব্যাপক ক্ষতিকর ভূমিকা সম্পর্কে মানসিক ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ কিংবা বিজ্ঞানীদের পর্যায়সহ সচেতন একটা শ্রেণি পর্যন্ত হয়তো জানে, বোঝে ও তার প্রতিকারে সম্ভাব্য চেষ্টাও অব্যাহত রাখে, কিন্তু এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা কিংবা সেই গবেষণার ফলাফল নিয়ে আপামর জনসাধারণের জীবনধারা পরিচালিত করার বাস্তবতা নেই। তবে উন্নত দেশগুলোতে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়ে থাকে; যা করোনাকালীন আরো বেশি করে হচ্ছে। কানাডায় এ সম্পর্কে এক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, করোনাকালীন কানাডায় কমপক্ষে ৪০ শতাংশ নাগরিকের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট হয়েছে, অ্যালকোহলজনিত আসক্তি বেড়েছে ও অন্য অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। ইপসসের জরিপ অনুযায়ী, করোনা মহামারিকালীন প্রেক্ষাপটে কর্ম হারানো, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং ভ্রমণ-সংক্রান্ত বিধিনিষেধের ফলে কানাডিয়ানদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারিতে ইথিওপিয়ার মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা তিন গুণ বেড়েছে। কানাডায় ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সিদের মধ্যে মদ্যপান বেড়েছে ২০ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের ৩২ শতাংশ জানিয়েছে, মহামারি মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি খারাপ করেছে। ইতালি ও স্পেনে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। চিকিৎসক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, বিচারক, রিকশাচালক, দিনমজুর, গৃহিণী, ছাত্র-শিক্ষক সব পেশা-শ্রেণির মানুষের ওপর গভীর মানসিক চাপ তৈরি করেছে মহামারি।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দেশে মাত্র আট লাখ আর বিশ্বে ১৭ কোটি হলেও সারা দেশের ও বিশ্বের সব মানুষ তীব্র মানসিক চাপে আছে। দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার তুলনায় এমনিতেই চিকিৎসা নেওয়ার হার অনেক কম। করোনাকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনে বাইরে কম মানুষ বের হওয়ায় সে হার আরো কমেছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে মহামারি শুরুর আগে দৈনিক গড়ে ৩০০ রোগী চিকিৎসার জন্য এলেও এখন তা অর্ধেকের কম বলে জানিয়েছে ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ। করোনাকালীন মানসিক সমস্যা অনেক বেশি মানুষকে আক্রান্ত করলেও মানসিক রোগীরা এ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা না নেওয়ায় পরিস্থিতি দিন দিন আরো বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে। করোনাকালীন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে একাধিক গবেষণা দেশে চলমান থাকলেও তার চূড়ান্ত ফলাফল এখনো প্রকাশ পায়নি। তবে এ রকম একাধিক গবেষণার অনলাইন জরিপে দেখা গেছে, শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ৪০ শতাংশ মানুষ করোনার কারণে মানসিক চাপে আছে। এই চাপের কারণে মেজাজ ঠিক থাকে না, উদ্বেগ বাড়ে, বিষণ্নতা বাড়ে, খাওয়ায় রুচি থাকে না, কাজে মনোযোগ থাকে না। মনোরোগ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসের মহামারি শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সি মানুষকে মানসিক সংকটের মধ্যে ফেলেছে। দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ১৫৫ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। এরই মধ্যে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে এপ্রিল মাসেই ২১ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া মার্চে তিনজন মারা যান। আর এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯১১ জন চিকিৎসক। এ ছাড়া নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ চিকিৎসাসেবা সংশ্লিষ্ট মোট ৮ হাজার ২০৭ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ৩০ এপ্রিল ২০২১ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন ও মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়।

চিকিৎসকদের ভাষ্য মতে, কখন কীভাবে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ ঘটে, তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী) পরা থাকলেও তাদের সারাক্ষণ সংক্রমণের ভয়ে থাকতে হচ্ছে। আমাদের মাধ্যমে বাসায় বাচ্চারা ও পরিবারের অন্যদের আক্রান্ত হয় কি না, সেই ভয়ে থাকার কারণে মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মহামারি মোকাবিলার সামনের সারির কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির যে তথ্য দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাতে দেখা যাচ্ছে, চীনে করোনা চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত থাকা স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ৫০ শতাংশ বিষণœতার রোগে, ৪৫ শতাংশ উদ্বেগজনিত রোগে এবং ৩৪ শতাংশ ঘুম না আসার সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর কানাডার স্বাস্থ্যকর্মীদের ৪৭ শতাংশের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন হয়েছে। করোনা মহামারির ব্যাপকতা অতি তীব্রতর এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাটিও বৈশ্বিক। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা, উন্নতি ও যত্নে গোটা সমাজকে যুক্ত করতে হবে; মানসিক স্বাস্থ্যের জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে; করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক গঠিত কমিটি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির খতিয়ান তৈরি করেছে, পজিটিভ রোগীদের রিপোর্ট দেওয়ার সময় মুঠোফোনে কাউন্সেলিং করার ব্যবস্থা নিয়েছেন, চিকিৎসকদের জন্য নির্দেশিকা তৈরি করে সে মতে কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে বাংলাদেশে করোনা মহামারি সফলভাবে মোকাবিলার মতো অচিরেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যারও লাঘব হবে বলে সবার বিশ্বাস।

করোনাকালীন মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে নিজেকে উজ্জীবিত রাখা, প্রাণ খুলে হাসা, পরিবর্তিত জীবনে নতুন স্বাস্থ্যকর দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করা, পরিবারের সদস্যদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম ও সুষম পুষ্টিকর খাবার মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখবে। দৈনিক হালকা ব্যায়াম করা, মানসিকভাবে নিজেকে উদ্দীপ্ত রাখতে যোগব্যায়ামও করতে পারলে আরো ভালো। আয়-ব্যায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন। যে কাজে যে আনন্দ পায় তা করা উচিত। যেমন ছবি আঁকা, গান শোনা ও বই পড়া। পরিবারের শিশুদের সময় দিন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে সাহায্য করুন তাদের পড়াশোনায় সহায়তা করুন, তাদের পছন্দের খেলায় তাদের সঙ্গে অংশ নিন। পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের আলাদা যত্নে নিন। ধূমপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্য পরিহার অবশ্যই করতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে প্রতিবেশীর খবর নিলে এবং অসহায়কে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করলে মন ভালো থাকবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি কমিয়ে ফেলুন। অবশ্যই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন।

মরণঘাতী এ ভাইরাসকে প্রতিহত করে মানসিকভাবে সুস্থ খাকতে হলে কোনো অবস্থায়ই মানসিক শক্তি হারানো যাবে না। সচেতনতা এবং সুদৃঢ় মানসিক মনোবল দিয়ে করোনাকালীন সব নেতিবাচকের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার সঙ্গে সঙ্গে মানবিকতা, নৈতিক দৃঢ়তা, ধর্মীয় অনুশাসন, পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা আমাদের করোনা যুদ্ধে জয়ী করবে। যেকোনো বিপদ মোকাবিলার প্রধান শর্ত ধৈর্য, দায়িত্বশীল আচরণ আর সাহস। নিজের ওপর আস্থা রেখে অতীতে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিজের দক্ষতা আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগতে হবে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সব জীবের শ্রেষ্ঠ হিসেবে সর্বোচ্চ জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যুগে যুগে তুলনামূলক অনেক কম বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সুবিধা নিয়েও নানা রকম বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মানুষ তার জীবনযাত্রার মান ক্রমাগতভাবে উন্নত ও আধুনিক করেছে। করোনাভাইরাসের ব্যাপকতায় মানসিক স্বাস্থ্যসহ অন্য সব ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ যত বেশিই হোক না কেন মানুষ তার অফুরন্ত জীবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সাধারণ সুখী জীবনে ফিরে আসবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বার্তা সম্পাদক, দৈনিক দর্পণ প্রতিদিন।
ganash74@hotmail.com