গনেশ চন্দ্র হাওলাদার

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে সম্ভাব্য সব রকম ব্যবস্থা যা সরকারের পক্ষে করা সম্ভব ছিল তা এরই মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় কয়েক দফায় মাসব্যাপী সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে করোনা মহামারি প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। তবে লকডাউন কার্যকর করতে সরকার তথা প্রশাসনের আন্তরিকতা ও চেষ্টা থাকলেও বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দীর্ঘ সময় কিংবা কঠোরতার সঙ্গে তা বলবৎ রাখা সম্ভব নয়। যদিও কোভিড-১৯-এর প্রকোপ কমাতে স্বাস্থ্যবিধির প্রধান মূলমন্ত্র সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার সবচেয়ে ভালো উপায় লকডাউন ব্যবস্থা; যা বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের হার হ্রাস করে এরই মধ্যে সফল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু জনবহুল একটি দেশ হিসেবে এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে একদিকে সরকার যেমন বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে, অন্যদিকে কিছুসংখ্যক মানুষের অসচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনীহার কারণে লকডাউন বাংলাদেশে স্বকীয়তা হারিয়েছে। তবে করোনা নামক এ ভয়াবহ ভাইরাস নিত্যনতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে করে কোনো দেশের অর্থনৈতিক সুবিধা-অসুবিধা কিংবা মানুষের গাফিলতি বিবেচনায় নিয়ে তার মরণঘাতী অগ্রযাত্রা যে থামাবে না, তা সহজেই অনুমেয়। তাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে প্রত্যেকের অমূল্য জীবন বাঁচাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে।

কোভিড-১৯ ভাইরাসটি বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী ও উন্নত দেশগুলোর মানুষদের কল্পনাতীত মাত্রায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর কারণ হওয়ায় এবং সব দেশে খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত টিকা বেশ কয়েকটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রযুক্তি ও নামে আবিষ্কার হয়েছে। দেশীয় নানা ধরনের অপপ্রচার ও বৈশ্বিক নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকারের সময়োপযোগী কর্মতৎপরতায় ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ক্রয় করে। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ডোজ এবং ৮ এপ্রিল দ্বিতীয় ডোজ টিকা প্রদান শুরু করে। যদিও ভারতে বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যুর কারণে চুক্তি অনুযাযী টিকা সরবরাহ না করায় প্রথম ডোজের টিকা প্রদান বন্ধ রাখা হলেও দ্বিতীয় ডোজ প্রদান যথারীতি চলমান রয়েছে। তবে ত্বরিতগতিতে নতুন করে রাশিয়ার স্পুৎনিক ও চীনের সিনোফার্মের টিকা ক্রয়ের ও দেশে উৎপাদনের চুক্তি করার ফলে এ সংকট অচিরেই নিরসন হবে আশা করি। তবে সব নাগরিককে টিকা দিতে হয়তো কয়েক বছর লেগে যাবে, তাই স্বাস্থ্যবিধি মানা বিশেষ করে ‘মাস্ক’ ব্যবহারের বাধ্যবাধকতাই সুরক্ষার অন্যতম উপায় বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

বাংলাদেশে ৮ মার্চ ২০২০ প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। এরপর ১৮ মার্চ প্রথম ব্যক্তির মৃত্যুর কথা জানায় আইইডিসিআর। ৩০ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত ১১ হাজার ৪৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং মোট সংক্রমিত হয়েছে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ১৩২ জন। সারা বিশ্বে ৩১ লাখ ৮৮ হাজার ১২১ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং মোট সংক্রমিত হয়েছে ১৫ কোটি ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৫৪৪ জন। উল্লেখ্য, চীনের উহান প্রদেশ থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে উৎপত্তি হওয়া নভেল করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ যেটি উহান শহরের বাজারে ৫৭ বছর বয়সি ওয়েই গুইশিয়ান নামক চিংড়ি মাছ বিক্রেতা এক মহিলাকে প্রথম আক্রান্ত করেছিল। করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে প্রথম সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত, যা পরবর্তীকালে সাত দফা বাড়িয়ে ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। বাংলাদেশে ২ মাস ৬ দিনের একনাগাড়ে জরুরি সেবা বাদে সব অফিস-আদালত, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সক ধরনের পরিবহন চলাচল বন্ধ, বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টাইনে ও আইসোলেশনে রাখাসহ স্বাভাবিক জনজীবন বন্ধ রেখে এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষের ঘরে থাকার সে সময়টাকে অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ‘লকডাউন’ বলা হয়নি, বরং সরকারিভাবে ‘সাধারণ ছুটি’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও পক্ষান্তরে তা লকডাউনই ছিল। তবে ঢাকার রাজাবাজার ও ওয়ারীসহ দেশের কয়েকটি অতি সংক্রমিত জেলা-উপজেলা পুরোপুরি কঠোর লকডাউন করা হয়েছিল। ২০২০ সালে নেওয়া বাংলাদেশ সরকারের এসব ব্যবস্থার কারণে করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কা সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় টেউ আরো অনেক বেশি তীব্রতা নিয়ে বাংলাদেশে আঘাত করে। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যু প্রথম টেউয়ের তুলনায় অনেক বেশি ঘটালেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কারণে তা ভারত, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রাজিলের ন্যায় ভয়াবহ হতে পারেনি।

ভাইরাসটি বিভিন্ন দেশে নিজের জটিল জিনগত বৈশিষ্ট্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তন করে আরো বেশি মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। এ কারেণই পাশর্^বর্তী দেশ ভারত করোনাভাইরাসের করাল ছোবলে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। সংক্রমণের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে ভারতের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক পরেই দ্বিতীয়তে। ভাইরাসের এই ধরনটি (বি.১.৬১৭) মার্চে দুবার রূপ বদলেছে বলে সেসময় জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। একাধিক রূপ বদলের কারণে ভাইরাসটি শরীরে দ্রুত ছড়াতে পারে। বিশেষ করে এর পক্ষে শরীরে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়াও সহজ হতে পারে। এখন পর্যন্ত বিশ্বে করোনাভাইরাসের ৪,০০০-এর অধিক ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান মিলেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ে তেমন মাথাব্যথার প্রয়োজন হয় না, কারণ নতুন সৃষ্ট বেশির ভাগ ভ্যারিয়েন্ট মূল ভাইরাসের চেয়ে দুর্বল এবং কম ক্ষতিকর হয়। এসবের মধ্যে কোনো ভ্যারিয়েন্ট কেবল তখনই বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার কারণ হয়; যখন তা দ্রুতগতিতে ছড়ায়, রোগের লক্ষণাদিতে পরিবর্তন আনে কিংবা অধিকতর শারীরিক সমস্যা কিংবা মৃত্যুর কারণ হয়। এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তকরণের নিয়মিত পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে যায়, প্রচলিত ওষুধ কিংবা চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এ ধরনের ভ্যারিয়েন্টগুলোকে ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন নামে অভিহিত করা হয়। বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের এ ধরনের চারটি ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত করেছেন, যথা ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭), সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১), ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (পি.১) এবং ক্যালিফোর্নিয়া ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৪২৭ এবং বি.১.৪২৯)। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটি (বি.১.৬১৭) গত কিছুদিনে ব্যাপক সংক্রমণ ও মৃত্যুর কারণ হলেও গবেষণা শেষ না হওয়ায় এটি ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন পর্যায়ভুক্ত হবে কি না, তা জানা যায়নি। দেশে গত মার্চে ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্টও শনাক্ত হয়েছে বলে রিপোর্ট এসেছে। তবে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট অধিক সংক্রমণ ঘটালেও ইউকে ভ্যারিয়েন্টের মতো অধিকতর প্রাণঘাতী নয়। মূল করোনাভাইরাসকে টার্গেট করে ইতোমধ্যে যেসব টিকা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সুরক্ষা নাও দিতে পারে। বিশ্বের নামকরা অন্যতম মেডিকেল জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এর সর্বশেষ পর্যালোচনা অনুযায়ী, কোভিড-১৯ ভাইরাস বাতাসে ভর করে ছড়ায়। তারা বলছে, জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলো যদি এটিকে বায়ুবাহিত ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হবে। এ তথ্য পুরোপুরি সত্য বলে প্রমাণিত হলে এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে বর্তমানে এ ভাইরাস প্রতিরোধে যেসব ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে; তা মহামারি ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট হবে না।

জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এমনিতেই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত। ভারতে করোনাভাইরাসের যে ভ্যারিয়েন্টটি বর্তমানে ভারতসহ বিশ্বের ২০ দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, সেটি ভারতে প্রতিদিন তিন থেকে প্রায় চার লাখ মানুষকে আক্রান্ত করছে এবং প্রতিদিন তিন হাজারের অধিক মৃত্যু ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে করোনাভাইরাসের আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ব্যাপকভাবে ছড়ানোর কারণে গত বছরের তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুহার অনেক অনেক বেশি। আর কোনোভাবে যদি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেশে প্রবেশ করে মানুষের দেহে ছড়ানোর সুযোগ পায়; তাহলে তা নিয়ন্ত্রণে আরো চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। আর সে ভয়কে সত্যে পরিণত করতেই কয়েক দিন আগে যশোর জেনারেল হাসপাতাল থেকে ভারতফেরত সাতজনসহ ১০ জন করোনা রোগী তাদের নিজ চারটি জেলায় পালিয়ে গেছে। যদিও পুলিশ তাদের এক দিনের মধ্যে ধরে হাসপাতালে ফেরত পাঠিয়েছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো সরকার কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকরণের জন্য লকডাউনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দিন-রাত চেষ্টা করে গেলেও অনেক মানুষ এসব ব্যবস্থা মানতে অনীহা দেখাচ্ছে।

প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতায় মহাবিশ্ব জয়ে নিত্যনতুন অগ্রগতি এবং পৃথিবীকে শতবার ধ্বংসের ক্ষমতা মানুষের হাতের মুঠোয় থাকলেও অতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাসকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মৃত্যুর এ বিভীষিকা মানবসভ্যতার আধুনিক যুগকেও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণ লড়াকু মনোভাবসম্পন্ন জনগোষ্ঠী হিসেবে বিভিন্ন সংকটকালীন প্রতীয়মান হয়েছে। বিশ্বের একমাত্র জাতি হিসেবে নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে জীবন দিয়েছে। মাত্র ৯ মাস এক রকম নিরস্ত্র অবস্থায় প্রতিপক্ষের অত্যাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসটি যদিও একটি অদৃশ্য বস্তু। তবে নিজেদের অমূল্য জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় সতর্কতা গ্রহণ, সরকারের প্রশাসনিক নির্দেশ মান্য করা, সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন-যাপনসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু করার চেষ্টাই অদৃশ্য মৃত্যুদূত এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে মরণযুদ্ধে বাঙালিদের জয়ী করবে।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, দৈনিক দর্পণ প্রতিদিন।
ganash74@hotmail.com