গনেশ চন্দ্র হাওলাদার
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রতিনিয়ত ভয়াবহভাবে বেড়ে চলেছে। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতায় মহাবিশ্ব জয়ে নিত্য নতুন অগ্রগতি এবং পৃথিবীকে শত শতবার ধ্বংসের ক্ষমতা মানুষের হাতের মুঠায় থাকলেও অতি ক্ষুদ্র একটি ভাইরাসকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না তাবৎ বিশ্বের পরাক্রমশালী দেশ ও বিজ্ঞানীরা। বিশ্বের প্রায় সকল দেশে (বিশ্বের ২০০টি দেশে) ইতিমধ্যে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস (Coronavirus)। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজারের বেশি মারা গেছেন। ইতালীতে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত ও মারা গেছেন প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ও স্পেনে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন মারা গেছেন ৯ হাজারের বেশি মানুষ। সারা বিশ্বে আক্রান্ত প্রায় ৯ লক্ষ এবং মৃত্যুবরণ করেছেন সাড়ে ৪৩ হাজার মানুষ।

চীনের উহান প্রদেশে গত জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে শুরু হয়ে মহামারী আকারে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। তবে তাদের ৮১৫৫৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত ও ৩৩১২ জন মৃত্যুর পর এ ভাইরাস নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হয়েছে বলে দাবী করছে। উৎপত্তিস্থল চীন আশ্চর্যজনক দ্রুততায় রক্ষা পেলেও তাদের দেশে শুরু হওয়া মৃত্যুর এ বিভিষিকা মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে করোনা ঝুঁকি কতটা?
জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত। তাছাড়া ১ কোটির বেশি বাংলাদেশী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করে বিধায় তাদের দেশে আসার মাধ্যমেই মূলতঃ আরও বেশি ঝুঁকিতে ফেলেছে দেশকে। গত ৮ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। এরপর ১৮ই মার্চ প্রথম ব্যক্তির মৃত্যুর কথা জানায় আইইডিসিআর। ২৫ই মার্চ প্রথম সংস্থাটি জানায় যে রাজধানী ঢাকায় সীমিত আকারে কম্যুনিটি সংক্রমণ হচ্ছে বলে তারা সন্দেহ করছে। ১ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪ জন, সুস্থ হয়েছেন ২৬ জন, আইসোলেশনে আছেন ৬২ জন, কোয়ারেন্টাইনে আছেন ২৬ হাজারের বেশি মানুষ এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৬ জন।
করোনাভাইরাসে বিভিন্ন দেশে ৫৩ বাংলাদেশির মৃত্যু:
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৩২ বাংলাদেশিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৫৩ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরে তা জানা গেছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রে ৩২, ব্রিটেনে ১১, ইতালিতে দুই, কাতারে দুই, সৌদি আরবে দুই, স্পেনে এক, সুইডেনে এক, লিবিয়ায় এক এবং গাম্বিয়ায় একজন বাংলাদেশি মার গেছেন।
আপাতঃ পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ ভাল অবস্থানে থাকলেও ইতালী, স্পেন, যুক্তরাষ্ট, যুক্তরাজ্য, জার্মানী, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, নেতারল্যান্ড, ইরান, কানাডার মত মহাশক্তিধর ও উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর ভয়াবহ সংখ্যা আমাদেরকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।

বিশেষ করে ইতালীসহ উল্লেখিত দেশগুলো থেকে গত দুই মাসে আসা কয়েক লক্ষ প্রবাসীদের প্রসাশনের নির্দেশনা না মেনে অবাধে ঘোরাঘুরি করায় এবং তথ্য পরিসংখ্যানে রোগটি তাদের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ায় সবাই অজানা ভয় ও আতঙ্কে রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বাধ্য হয়ে উন্নত বিশ্ব ও ভারতসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের ন্যায় একের পর এক কঠোর ব্যবস্থা ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছে। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে প্রথম ২৬ মার্চ থেকে আগামী ৪ এপ্রিল এবং দ্বিতীয় দফায় ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। ছুটির সময়ে অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে গণপরিবহন, সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসময় সারা দেশের মানুষ যাতে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করে সে ব্যাপারে বেসামরিক প্রশাসনের সাথে সেনাবাহিনীও মাঠে থেকে কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। দেশে আসা প্রবাসীদের তাই এখন হোম কোয়ান্টোইনে রাখা নিশ্চিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে পর পর দুই দিন নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। বিশ্বের সকল দেশের সাথে আকাশ, নৌ ও স্থল পথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

কোন কোন মহলের মতে, রোগ নির্নয়ের জন্য অত্যাবশ্যাকীয় কীট এর স্বল্পতার কারনে প্রথমদিকে যেমন খুবই সীমিত সংখ্যক মানুষের পরীক্ষা করেছে এ বিষয়ে তখনকার একমাত্র প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশ থেকে কীট সংগ্রহ করা হলেও এবং অনেকগুলো হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষার জন্য নির্ধারন করে দিলেও যোগাযোগের জন্য অনলাইন ও হটলাইন ফোন বাধ্যতামূলক হওয়ায় চেষ্টা করেও উপসর্গযুক্ত অনেকেই পরীক্ষা করাতে পারছেন না। এছাড়া গ্রীষ্মকালীন সাধারণ সর্দি, কাশি, জ্বর বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর চিরাচরিতভাবে হয়ে থাকে বিধায় আতঙ্কে সাধারন মানুষ যেমন করোনা ভেবে পরীক্ষা করাতে চায় বিপরীতভাবে সেবার ব্রত নিয়ে মহৎ পেশায় নিয়োজিত ডাক্তারগণও নিজের জীবনের ঝুঁকি বিবেচনায় আতঙ্কে এবং পিপিই না পাওয়ার কারনে এজাতীয় কোন রোগীকেই চিকিৎসা করতে গত কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ইচ্ছুক ছিল না। ফলশ্রুতিতে চিকিৎসা না পেয়ে অন্য রোগে প্রতিদিন দু-একজন মৃত্যুবরণ করছে বিধায় সাধারণ মানুষ করোনায় মৃত্যু ধরে নিয়ে সরকারকে দোষরোপ করছে। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির দেহে উপসর্গ দেখা দিতে ৫ দিন লেগে যাওয়ায় এসময় তার মাধ্যমে অপর ব্যক্তিদের আক্রান্ত হওয়া এ রোগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হওয়ায় ইতালীর ন্যায় ব্যাপক সংখ্যক বাংলাদেশী সংক্রামনের ঝুঁকিতে রয়েছে। যদিও বর্তমানে পিপিই যথেষ্ট পরিমানে সরবারাহ করা হয়েছে। বেসামরিক চিকিৎসকদের পাশাপাশি সেনাবাহিনী তাদের ডাক্তারদের মাধ্যমে আলাদাভাবে ক্যাম্প খুলে চিকিৎসা প্রদান শুরু করেছে। দরিদ্র মানুষদেরকে প্রধানতঃ সরকারী মাধ্যমে ও কিছু কিছ বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের মাধ্যমে খাদ্য সহয়তা প্রদান শুরু হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু সম্পর্কে চব্বিশঘন্টা মনিটর করছেন, প্রশাসনসহ দলের মন্ত্রী, এমপি, নেতা-কর্মীদের প্রয়োজনমত নতুন নতুন গাইডলাইন দিয়ে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রনে রাখতে যা যা করা সম্ভব তার সবকিছুই করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

তবে করোনা রোগটি অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে হওয়ায় এ রোগীর ধারে-কাছে কেহ যেতে চায় না বলে এ রোগের অনুরূপ অন্য রোগীরা যেমন মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছেন, তেমনি নিজের অজান্তে আক্রান্ত রোগিরাও সঠিক সময়ে চিকিৎসা সেবা না পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা বিবেচনায় উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
সরকার সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকরনকে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রন করার উদ্দেশ্য নিয়ে সাধারণ ছুটি দিলেও বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ঢাকা ত্যাগ করে গ্রামে চলে যাওয়ায় এবং সচেতনতার অভাবে কেহ কেহ ঘরে না থেকে হাটে-ঘাটে-মাঠে ঘুরে বেড়ানো, চায়ের দোকানে স্থানীয় বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দেয়ায় ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়ার কারন হয়ে দাড়াতে পারেন।
অর্থনৈতিক ঝুঁকির কথা মাথায় রাখলে উন্নত বিশ্ব যেখানে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার বিভিন্ন খাতে বরাদ্ধ রেখেও ভবিষ্যত অর্থনৈতিক বিপর্যয় এর আশঙ্কা করছে, সেখানে উন্নয়নশীল ও স্বল্প আয়ের বিপুল সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও সরকার গার্মেন্টস খাতসহ নানা খাতে ইতিমধ্যে অর্থ বরাদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং দরিদ্র জনগোষ্টিকে বিনা মূল্যে ও স্বল্প মূল্যে খাদ্য সরবরাহ শুরু করেছে। এছাড়া সমাজের বিত্তবানরাও কেহ কেহ এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন।

কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় বাংলাদেশের বিশেষ অবস্থান:
১. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে মাত্র ১৫ মিনিটে রেজাল্ট পাওয়ার মত করোনাভাইরাস শনাক্তের কীট উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন। ড. বিজন ও তার দলের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে পরীক্ষাটি ২৫০ টাকায় করা যাবে। সরকার সাথে সাথে তাদের পরীক্ষামূলক কীট উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানীর অনুমতি প্রদান করেছে।
২. করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে পিপিই নিয়ে সবাই যখন দু:চিন্তাগ্রস্থ ঠিক তখন এগিয়ে এলেন আর এক মহতী নারী বিশ্ববিখ্যাত পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার (এমঅ্যান্ডএস) এর কান্ট্রি ডিরেক্টর স্বপ্না ভৌমিক। তার নেতৃত্বে বুয়েটের একদল অ্যালামনাই সদস্য করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চিকিৎসকদের জন্য তৈরি করছেন সুরক্ষা পোশাক। ৪ লাখ স্বাস্থ্য সরঞ্জাম বা পিপিই বিনামূল্যে বিতরণ করবেন তিনি।
৩.আকিজ গ্রুপের ৩০১ শয্যা বিশিষ্ট করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় বিশেষ হাসপাতাল তৈরি প্রায় শেষ পর্যায়ে। দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপ বসুন্ধরা গ্রুপ ৫০০০ শয্যা বিশিষ্ট বিশেষ হাসপাতাল ঘোষণা দিয়েছে।
৪. বেক্সিমকো গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, বিজিএমই, ইউএস বাংলা, স্লোটেক্স গ্রুপ সহ অনেক প্রতিষ্ঠান পিপিই ও চিকিৎসা সরঞ্জাম বিনামূল্যে প্রদান করেছে।

টিকা আবিস্কার এর পূর্ব পর্যন্ত কোভিড-১৯ প্রতিরোধের উপায়ঃ
তবে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট, জার্মানী, জাপানসহ কয়েকটি দেশ আবিস্কার করার কথা বললেও তা টিকা আকারে আসতে কমপক্ষে এক দেড়বছর লাগবে বিধায় এ রোগটিকে নিয়ন্ত্রন করার মাধ্যমে মৃত্যু এড়ানোই বর্তমান সময়ে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। সংক্রামন প্রতিরোধের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ঝুঁকি কমাতে পারে। প্রতিরোধ করার জন্য এ ভাইরাসটি সর্ম্পকে বিস্তারিত সকল কিছু জানা প্রত্যেক মানুষের জন্যই অত্যাবশ্যাকীয়।
করোনাভাইরাস, যার পোশাকি নাম কোভিড-১৯, সেই রোগটিকে এখন বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। করোনা (COVID-19 ) সর্ম্পকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সহ অন্যান্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অনুজীব বিজ্ঞানীরাদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হল:
ভাইরাস কি?
ভাইরাস (Virus) হল একপ্রকার অতিক্ষুদ্র জৈব কণা বা অণুজীব যারা জীবিত কোষের ভিতরেই মাত্র বংশবৃদ্ধি করতে পারে। এরা অতি-আণুবীক্ষণিক এবং অকোষীয়। ভাইরাস ল্যাটিন ভাষা হতে গৃহীত একটি শব্দ। এর প্রাচীন অর্থ হল বিষ। ভাইরাস বলতে এক প্রকার অতি ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক অকোষীয় রোগ সৃষ্টিকারী বস্তুকে বোঝায়। উদ্ভিদ ও প্রাণীর বহু রোগ সৃষ্টির কারণ হল ভাইরাস। ভাইরাস কে জীবাণু না বলে ‘বস্তু’ বলা হয়। কারণ, জীবদেহ ডিএনএ,আরএনএ ও নিওক্লিক এসিড দিয়ে গঠিত, প্রোটিন তাই ভাইরাস অকোষীয়।

করোনাভাইরাসটি কি?
ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯ – এনসিওভি বা নভেল করোনাভাইরাস। এটি এক ধরণের করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ছয়টি প্রজাতি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। তবে নতুন ধরণের ভাইরাসের কারণে সেই সংখ্যা এখন থেকে হবে সাতটি। নতুন ভাইরাসটির জেনেটিক কোড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এটি অনেকটাই সার্স ভাইরাসের মতো। করোনা শব্দের অর্থ জ্যোতির্বলয়। এ ভাইরাসটি সূর্য থেকে ছিটকে পড়া আলোকরশ্মির মতো বলে এর নামকরণ করা হয় করোনাভাইরাস।

করোনাভাইরাস এর উৎপত্তিগত ইতিহাসঃ
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে মধ্য চীনের হুপেই প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী এবং চীনের ৭ম বৃহত্তম নগরী উহান নগরীতে একটি নতুন ধরনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যাকে নোভেল করোনাভাইরাস (২০১৯-এনসিওভি) নামকরণ করে। ক্রমেই ভাইরাসটি চীনের বাইরে আরো কয়েকটি দেশে ধরা পরে। অতিদ্রুত জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও চীন কিছুটা দেরী করে ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে প্রথম ভাইরাসটির সংক্রমণের কথা অবহিত করেন। ভাইরাসের কারণে চীনে ২০২০ সালের ৯ই জানুয়ারি প্রথম ব্যক্তিটি মারা যায়।

কতটা ভয়ংকর এই ভাইরাস?
বিশ্বে মানবসভ্যতার ইতিহাসে ক্ষতিকর ভাইরাসের মধ্যে কোভিড-১৯ সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর ও মরনঘাতী হিসেবে বর্তমান সময়ে আর্বিভূত হয়েছে। শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য অসুস্থতার মতো এই ভাইরাসের ক্ষেত্রেও সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা এবং জ্বরসহ হালকা লক্ষণ দেখা দিতে পারে । কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অর্গান বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই এই রোগ মারাত্মক হয়। এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বয়স্ক ও আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম তাদের এ রোগে মৃত্যু ঝুঁকি বেশি।

কোভিড-১৯ রোগের লক্ষ্মণ কি?
১. জ্বর ও শুকনো কাশি সঙ্গে অবসাদ ও কফ।
২. শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া।
৩. মাংশপেশিতে ব্যথা।
৪. অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া।
৫. কারও ক্ষেত্রে ডায়রিয়াও দেখা দিতে পারে।
৬. কিছু ক্ষেত্রে জিহ্বার মাধ্যমে খাদ্যের স্বাদ বুঝতে না পারা এবং চোখ লাল হওয়ার মত লক্ষণও দেখা যায়।
৭. নিউ ইয়র্কের চিকিৎসকরা কম পরিচিত একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে হার্ট অ্যাটাকের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন।
তবে প্রধানত শুষ্ক কাশি ও জ্বরের উপসর্গের মাধ্যমেই শুরু হয়, পরে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে।

লক্ষণ প্রকাশের সময়কালঃ
ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে গড়ে ৫ দিন সময় লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তারপর দেখা দেয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। সাথে অবসাদ ও কফ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে কিছু কিছু গবেষকের মতে এর স্থায়িত্ব ২৪দিন পর্যন্ত থাকতে পারে।
লক্ষণ সনাক্তের সমস্যা:
শুরুর দিকের উপসর্গ সাধারণ সর্দিজ্বর এবং ফ্লু’য়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া স্বাভাবিক।
মানুষের মধ্যে যখন ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেবে তখন বেশি মানুষকে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে তাদের। তবে এমন ধারণাও করা হচ্ছে যে নিজেরা অসুস্থ না থাকার সময়ও সুস্থ মানুষের দেহে ভাইরাস সংক্রমিত করতে পারে মানুষ।

ড. দেবি শেঠীর মতে লক্ষণসমূহঃ
দেবি শেঠী জানিয়েছেন, যদি কারো ফ্লু বা সর্দি থাকে, প্রথমে নিজেকে আইসোলেট করে লক্ষণ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রথম দিন শুধু ক্লান্তি আসবে। তৃতীয় দিন হালকা জ্বর অনুভব হবে। সঙ্গে কাশি ও গলায় সমস্যা হবে। পঞ্চম দিন পর্যন্ত মাথা যন্ত্রণা। পেটের সমস্যাও হতে পারে। ষষ্ঠ বা সপ্তম দিনে শরীরে ব্যথা বাড়বে এবং মাথা যন্ত্রণা কমতে থাকবে। তবে ডায়েরিয়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে। পেটের সমস্যা থেকে যাবে। এবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অষ্টম ও নবম দিনে সব লক্ষণই চলে যাবে। তবে সর্দির প্রভাব বাড়তে থাকে। এর অর্থ আপনার প্রতিরোধক্ষমতা বেড়েছে এবং আপনার করোনার আশঙ্কা নেই।
তিনি বলেন, ‘এমন সময়ে আপনার করোনাভাইরাসের পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। কারণ আপনার শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। যদি অষ্টম বা নবম দিনে আপনার শরীর আরও খারাপ হয়, করোনা হেল্পলাইনে ফোন করে অবশ্যই পরীক্ষা করে নিন।’
যেভাবে করোনা ভাইরাস ছড়ায়
কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎপত্তি বা চরিত্র সম্পর্কে এখনও পর্যাপ্ত তথ্য মেলেনি। তবে একটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে মারণ-ভাইরাসটি অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে এবং এই জীবাণু মানুষের থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে আক্রান্ত কারোর হাঁচি, কাশি, নাক ঝাড়া বা নাকে-মুখে হাত দিয়ে সুস্থ মানুষের সংস্পর্শে এলে ছড়িয়ে পড়তে পারে ভাইরাস। সবচেয়ে জরুরি বিষয়, এই জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছে যায়।
বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এ ভাইরাসটি একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে দ্রুত ছড়াতে পারে। করোনা ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়।

ভাইরাস থেকে বাঁচতে/নিরাপদ থাকতে যা যা করতে হবে:
১. বারবার প্রয়োজনমতো নিয়মিত ২০ সেকেন্ড ধরে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত রগড়ে/কচলিয়ে পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন। প্রয়োজনে সাবান পানির বিকল্প হিসেবে ৬০% অ্যালকোহল আছে, এমন হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়েও হাত পরিষ্কার করা চলবে।


২. হাত না ধুয়ে চোখ, নাক, মুখে হাত দেবেন না।
৩. হাঁচি-কাশির সময়ে টিস্যু অথবা কাপড়/রুমাল দিয়ে বা বাহুর ভাঁজে নাক-মুখ ঢেকে ফেলুন। ব্যবহূত টিস্যু ঢাকনাযুক্ত ময়লা পাত্রে ফেলুন। হাত, কাপড়/রুমাল সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৪. বাইরে বের হলে কিংবা ঘরে লক্ষণযুক্ত ব্যক্তি থাকলে মাস্ক ব্যবহার করুন।
৫. আক্রাক্ত ব্যক্তি হতে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন এবং মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, চশমাসহ প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম পরিধান না করে জীবিত কিংবা মৃত আক্রাক্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ না করা/সন্নিকটে যাবেন না।
৬. হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি থেকে বিরত থাকুন।
৭. ভ্রমণকারীগণ আক্রান্ত হলে কাশি শিষ্টাচার অনুশীলন করতে হবে (আক্রান্ত ব্যক্তি হতে দূরত্ব বজায় রাখা, হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা, হাত ধোয়া, যেখানে সেখানে কফ ও থুথু না ফেলা)। কাছাকাছি কাউকে হাঁচতে বা কাশতে দেখলে, দূরত্ব রাখুন।
৮. রান্নার আগে খাবার ভাল করে ধুয়ে নিন এবং সেদ্ধ করুন।
৯. ময়লা কাপড় বেশিদিন জমিয়ে না রেখে দ্রুত ধুয়ে ফেলুন।
১০. জীবিত অথবা মৃত গৃহপালিত/বন্যপ্রাণী থেকে দূরে থাকা।
১১. কমপক্ষে একনাগারে ১৪ দিন ঘরে থাকা। খুব দরকার হলে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে ভিড় এড়িয়ে চলাচল করা।
১২. বসবাসকারী দেশের রাস্ট্র কর্তৃক নির্দেশিত সময়কালে ঘর থেকে বের না হওয়া।
১৩. কোনও লক্ষণ দেখলে করোনা চিকিৎসা দেয়া হয় এরকম হাসপাতালে যান।
১৪. অযথা আতঙ্কিত হবেন না এবং গুজব ছড়াবেন না।
১৫. অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে।

চীন যে মূল নীতিতে কোভিড-১৯ মোকাবিলা করছেঃ
যে কোন সংক্রামক ব্যাধি থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, বিশেষ করে যাঁদের শ্বসনযন্ত্রে আগে থেকেই সংক্রমণ আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এটি অনস্বীকার্য। চীন নিম্নলিখিত মূলনীতি অনুসরন করেছে।
১. প্রথমতঃ যেহেতু আমাদের হাতে এই ভাইরাস দমনের কোনো ওষুধ বা টিকা নেই, সেহেতু আমাদের ‘নন ফার্মাসিউটিক্যাল’ কৌশল বেছে নিতে হবে।
২. দ্বিতীয়ত, আপনাকে যে করেই হোক অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে।
৩.তৃতীয়ত, একজনের সঙ্গে আরেকজনের সংস্পর্শ এড়াতেই হবে।
৪. চতুর্থত, সব ধরনের জনসমাগম বন্ধ করে দিতে হবে।
৫. পঞ্চমত, অবস্থা বুঝে সম্পূর্ণ লকডাউনে চলে যেতে হবে। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট এলাকা ঘেরাও করে সিল্ড করে দিতে হবে।

বয়স্কদের ঝুঁকি বেশি?
করোনাভাইরাস মারাত্মক হয়ে ওঠার ঝুঁকি বেশি বয়স্ক মানুষের মধ্যে। বিশেষত, যাঁরা হার্ট, ফুসফুস বা ক্যান্সারে ভুগছেন, ডায়াবিটিস বা অন্য কোনও রোগের কারণে যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁদের ক্ষেত্রে এই মারণ-ভাইরাস নিউমোনিয়ার মতো উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে। যার জেরে প্রাণহানির ঝুঁকি বেড়ে যায়।

শিশু-কিশোররা কি ঝুঁকিতে?
যে কোন বয়সের মানুষই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে একজন মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ইলিনয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, শিকাগোতে মৃত শিশুটির বয়স এক বছরের কম। মৃত্যুর আগেই তার শরীরে কোভিড-১৯ ধরা পড়েছিল।
তবে বাংলাদেশে ১০ বছরের কম বয়সী দুই জনের আক্রান্তের তথ্য পাওয়া গেছে । প্রধানত: আগে থেকে অসুস্থ বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস মারাত্মক হতে পারে।
এর আগে চীনে করোনাভাইরাস আক্রান্ত এক বছরেরও ছোট একটি শিশুর মৃত্যুর খবর হয়েছিল, কিন্তু আগে থেকেই ওই শিশুটির বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত জটিলতা ছিল।
গত সপ্তাহে ফ্রান্সের ঊর্ধ্বতন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জেরোমে সলোমন প্যারিসের ইলে-দে-ফ্রান্স এলাকায় কোভিড-১৯ এর রোগী ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিলেন।
একই সপ্তাহে ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলসের জনস্বাস্থ্য বিভাগও এক কিশোরের কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর দিয়েছিল।

করোনাভাইরাস কি বেশি তাপমাত্রায় কম ছড়ায়?
বাংলাদেশে সংক্রমনের প্রথমদিকে মনে করা হত ২৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রর অধিক তাপমাত্রায় কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিস্তার হয় না। পরবর্তীতে ২৩ ডিগ্রীর স্থলে ৬৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার কথা ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে তাপমাত্রার এ সূত্র সমর্থিত হয়নি। তবে বিশ্বের শীত প্রধান দেশগুলোতে এ ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমন ও মৃত্যু হয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মত প্রতিবেশী দেশগুলোতে বর্তমানে গ্রীষ্মকালীন অধিক তাপমাত্রা থাকায় ও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় এখনও বাংলাদেশের মানুষের ধারনা তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি।

কোন প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস?


একবার যদি ভাইরাসের উৎস প্রাণীটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে রোগটি মোকাবেলা করা অনেক সহজ হয়। করোনাভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে চীনের উহানের দক্ষিণ সমুদ্রের খাবারের পাইকারি বাজারের সঙ্গে। যদিও বেশ কিছু সামুদ্রিক প্রাণী করোনাভাইরাস বহন করতে পারে (যেমন বেলুগা তিমি), ওই বাজারটিতে অনেক জীবন্ত প্রাণীও পাওয়া যেত, যেমন মুরগি, বাদুর, খরগোশ, সাপ- এসব প্রাণী করোনাভাইরাসের উৎস হতে পারে। গবেষকরা বলছেন, চীনের হর্সশু নামের একপ্রকার বাদুরের সঙ্গে এই ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে।

পুরুষ না নারীর মৃত্যু ঝুঁকি বেশি?
চীন থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করে জানা যায় যে, এই রোগে নারীদের চেয়ে পুরুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা সামান্য বেশি।

করোনাভাইরাসের ওষুধ বা টিকা আবিষ্কার কত দূর?
মানব-শরীরে এই মারণ-ভাইরাসের কোনও অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি। তবে চীন দাবী করেছে তাদেও দেশে ভাইরাসটির নিয়ন্ত্রনে জাপানের ওষুধ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। জাপানও ভাইরাসটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়া থেকে নিজ দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে।
অন্যদিকে চীনের চিকিৎসা কর্মকর্তারা বলেছেন, জাপানে ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হওয়া একটি ওষুধ করোনার চিকিৎসায় ব্যবহার করে তারা সফলতা পেয়েছে। চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ঝ্যাং সিনমিন সাংবাদিকদের বলেছেন, ফাভিপিরাভির নামের ওই ওষুধ প্রস্তুত করেছে জাপানের বহুজাতিক কোম্পানি ফুজিফিল্মের সহযোগী ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টয়ামা কেমিক্যাল। এটি একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ। ওষুধটি চীনের উহান ও শেনজেন এলাকার ৩৪০ জন করোনা সংক্রমিত রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়। এতে ব্যাপক ও কার্যকর সফলতা পাওয়া গেছে।
জাপানের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে এক খবরে জানায়, যে রোগীদের ওপর ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়েছে, তারা গড়ে চার দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছে। যেখানে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া অন্য রোগীদের সেরে উঠতে সময় লেগেছে ১১ দিন। এ ছাড়া রোগীদের বুকের এক্স-রের মাধ্যমে জানা গেছে, যেসব রোগীর শরীরে ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়েছে, তাদের ফুসফুসের অবস্থা ৯১ শতাংশ উন্নতি হয়েছে। যাদের ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়নি, তাদের ওই সময়ে ফুসফুসের উন্নতি ঘটেছে ৬২ শতাংশ।
শনিবার চীনের মধ্য প্রদেশ হুবেইয়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এ তথ্য জানিয়েছে। খবর বিবিসি বাংলার। বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি করা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস যার নাম এখন কোভিড-১৯। এই রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে কাজ চলছে। এই রোগের ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।
ভ্যাকসিন আবিষ্কার তাহলে কত দূর?
কেউ হয়তো আশা করছেন কোনো একটি ঔষধ কোম্পানি দ্রুত এর ভ্যাকসিন বা টিকা বা প্রতিষেধক বাজারে আনবে। টিকা বা প্রতিষেধক সফলভাবে বের করে আনা বেশ জটিল কাজ। আর এর জন্য দরকার অনেক সময়। টিকার ক্ষেত্রে বিক্রির অনুমতি পাওয়ার আগে অনেক সময় লম্বা সময় ধরে হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। যদিও ২০০২ ও ২০০৩ সালে সার্সের সময় কোনো টিকাই আনা যায়নি এবং সার্সের জন্য এখনও কোনো টিকা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশা করছে দেড় বছরের মধ্যে এ ভ্যাকসিন বাজারে আসবে।

বাংলাদেশ সরকারের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশেষ কিছু উদ্যোগ:

১. করোনা শনাক্তে ডিজিটাল ম্যাপ ব্যবহার: করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ও উপদ্রুত এলাকা চিহ্নিত করতে সব গ্রাহকের মোবাইল ফোনে পাঁচটি করে প্রশ্ন – বয়স কত, জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট আছে কিনা, সম্প্রতি বিদেশ থেকে ফেরা কারও সংস্পর্শে এসেছেন কি না, করোনা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এসেছেন কি না, এবং দীর্ঘ মেয়াদি কোনো অসুখে ভুগছেন কি না,পাঠানো হচ্ছে। সেই প্রশ্নের উত্তরের ভিত্তিতে আক্রান্ত ব্যক্তি ও এলাকার ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করবে সরকার। এতে করে কোন এলাকায় কে রোগী তা সহজেই চিহ্নিত করা যাবে। গ্রাহকেরা এই সব প্রশ্নের উত্তর এসএমএস আকারে পাঠাতে পারবেন, চাইলে ফোনও করতে পারবেন। নিজের মোবাইল ফোন থেকেও *৩৩৩২# ডায়াল করে কোনো চার্জ ছাড়াই তথ্য জানাতে পারবেন। সবই হবে টোল ফ্রি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা http://corona. gov. bd এই ঠিকানাতে ঢুকে তথ্য দিতে পারবেন। এর বাইরেও বিকাশ, জিপি, রবি, বাংলালিংক ও উবারের অ্যাপের মাধ্যমে সহজেই তথ্য জানাতে পারবেন। তথ্য জানানোর জন্য কাউকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না। সঙ্গে সঙ্গে জানাতে পারবেন। দিনে লাখ লাখ দেওয়া যাবে। প্রতি ছয় ঘণ্টা পরপর মোবাইল অপারেটররা এই তথ্য এনটিএমসির কাছে হস্তান্তর করবে। তারা সেই তথ্যের ভিত্তিতে ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করবে। এই ম্যাপ হবে ৯৫-৯৮ শতাংশই বিশ্বাসযোগ্য। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া করোনা এলাকা চিহ্নিত করতে ডিজিটাল ম্যাপ ব্যবহার করে সুফল পেয়েছে। তারা ঘরে বসেই জানতে পেরেছে কোথায় কত রোগী হচ্ছে, কমছে না বাড়ছে। বাংলাদেশেরও ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি ও তথ্য বিন্যাসের সক্ষমতা আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সরকার এখন সেই পথেই হাঁটছে।
২. করোনাভাইরাস মোকাবেলা স্থানীয়ভাবে ভেন্টিলেটর (কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার যন্ত্র) উৎপাদন করবে বাংলাদেশ।
৩.বিদেশফেরত ব্যক্তিদের অবশ্যই ১৪ দিন বাড়িতে অবস্থানের পরামর্শ দিয়েছে রোগতত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)।কোয়ারেন্টেনের এই ১৪ দিন বাড়িতে অবস্থানের ক্ষেত্রে তাঁদের স্বজনদেরও সচেতন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বজন, বাড়িওয়ালা, প্রতিবেশীসহ সমাজের সবার সহযোগিতা কামনা করছে সরকার।
৪.সাধারণ লক্ষণ বা উপসর্গ নিয়ে সরাসরি না এসে বাসায় থেকেই আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করে উপদেশ ও পরামর্শ পাওয়া যাবে।
৫.করোনাভাইরাস সম্পর্কে যেকোনো পরামর্শ বা উপদেশের জন্য উল্লেখিত হটলাইনে যোগাযোগের অনুরোধ জানানো হয়েছে : ৩৩৩, ০১৯৪৪৩৩৩২২২, ০১৪০১১৮৪৫৫১; ০১৪০১১৮৪৫৫৪; ০১৪০১১৮৪৫৫৫; ০১৪০১১৮৪৫৫৬; ০১৪০১১৮৪৫৫৯; ০১৪০১১৮৪৫৬০; ০১৪০১১৮৪৫৬৮; ০১৯২৭৭১১৭৮৫; ০১৯৩৭০০০০১১; ০১৯২৭৭১১৭৮৪ এবং ০১৯৩৭১০০১১।
৬.স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইন নম্বর হচ্ছে-১৬২৬৩।
৭. এ ছাড়া ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও ই-মেইল বার্তা পাঠানো যাবে। ফেসবুক আইডি: Iedcr, COVID-19 Control Room, e-mail : iedcrcovid19@gmail.com.
৮.করোনাভাইরাস সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রচার নজরে এলে তথ্য অধিদপ্তরের সংবাদ কক্ষের ফোন নম্বর : ০২-৯৫১২২৪৬; ০২-৯৫১৪৯৮৮; ০১৭১৫২৫৫৭৬৫; ০১৭১৬৮০০০০৮ এবং ই-মেইল : piddhaka@gmail.com/piddhaka@yahoo.com অথবা ৯৯৯-এ নম্বরে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কিভাবে পালন করব?
কিন্তু সামাজিক দূরত্ব ব্যাপারটা হল – নিজের বাসায় থাকা, ভিড়ে না যাওয়া, একজন আরেকজনকে স্পর্শ না করা
১. নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে যেতে পারেন। কম যাবেন। যাবেন তখন, যখন কম লোক থাকে বাজারে। সেখানে যাবেন, যেখানে কম ভিড় থাকে। মোটকথা ভিড় এড়িয়ে চলুন।
২. বাজার থেকে বের হয়েই হাতে স্যানিটাইজার ব্যবহার করবেন। এসেই ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেবেন। তরকারি ফল ধুয়ে নেবেন। বক্স নাড়ার পরই হাত ধোবেন।
৩. খাবার কিনে মজুত করবেন না। খাদ্যশস্য কম পড়ার কোনো কারণ ঘটেনি।
৪. খাদ্য থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কথা শোনা যায়নি। তবে যে প্যাকেটে খাবার আনা হবে, সেটা ধরার পর হাত ধুয়ে নিতে হবে। আর কাঁচা সালাদ ফল বাইরে থেকে নিশ্চয়ই আনাবেন না। আর যিনি খাবার নিয়ে আসবেন, তাঁকে বলবেন খাবার দরজার বাইরে রেখে দিতে। দাম ও টিপস দেবেন দুরত্ব বজায় রেখে অথবা অনলাইনে।
৫. গণপরিবহন এড়িয়ে চলুন। তা না হলে সঙ্গে করে স্যানিটাইজার নিয়ে যান। হাতল ধরার পরেই হাত পরিষ্কার করুন। নামার সঙ্গে সঙ্গে হাত পরিষ্কার করুন।
৬. অফিস ছুটি না দিলে যতটা সম্ভব সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং করুন। দরকার হলে, মাস্ক ব্যবহার করুন।
৭. যতটা পারেন, বাসায় থাকুন। হাসপাতালে, বাজারসদাই করতে যেতে হতেই পারে। সিনেমা, থিয়েটার, প্রার্থনাগৃহ, জাদুঘর—সব বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এসব জায়গায় ভবিষ্যতে যাওয়া যাবে। এখন না।
৮. এখন ভ্রমণ, দেশের ভেতরে বা বাইরে, করা নিষেধ। বাস, ট্রেন, প্লেন, জাহাজ, লঞ্চ লোকে ভরা থাকে। তবে যাঁদের কাজই ভ্রমণসংক্রান্ত, যেমন এয়ারলাইনসের ক্রু, ট্রেনের চালক, তাঁদের কথা আলাদা।
৯. আপনি বাইরে বেরোলে মাস্ক পরেই বের হন। আপনার নিজের হাঁচিকাশি থাকলে দয়া করে বাইরে বের হবেন না।
১০.ঘরের বাইরে ফাঁকা জায়গায় ব্যায়াম করুন। কিন্তু জিমে নয়।
১১. খুব বেশি দরকার না হলে চিকিৎসকের কাছে যাবেন না। করোনাভাইরাস সন্দেহ হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। প্রথমে ফোনে যোগাযোগ করবেন।
১২. রোগী দেখতে যাবেন না।
১৩. প্রবীণ স্বজন-পরিজনদের দেখতে যাবেন না। ফোনে খোঁজ নিন। বাজারসদাই লাগলে সাহায্য করুন।
১৪. বন্ধুরা আপনার কাছে আসতে পারবে না। ফোনে কথা বলুন। ভিডিও চ্যাট করুন।
১৫. বাচ্চারা খেলতে পারবে বাইরে একা একা, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে? না। পার্কেও নিয়ে যাওয়া যাবে না।
১৬. সন্তানের কাছে যেতে পারবেন। তবে যদি আপনি মনে করেন দুজনের একজন এরই মধ্যে সংক্রমিত হয়ে আছে, তাহলে দূরত্ব বজায় রাখুন।
১৭. আমার রুমমেট হাসপাতালে চাকরি করলে তার থেকে দূরে থাকুন?

কত দিন এই রকম সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে হবে?
সম্ভবত কমপক্ষে পাঁচ মাস। পরে আবারও করতে হতে পারে। এটা একেবারে সেরে যাবে না সহসা। ঢেউয়ের মতো আসতে থাকবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটিকালীন সময়ে করোনাভাইরাস এর বিস্তার কর্তমান সময়েরমত নিয়ন্ত্রনে থাকলে আস্তে আস্তে সব কিছু খুলে দেয়া হবে।

মানুষ কবে নাগাদ তাদের স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনে ফিরতে পারবে?
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, আগামী ১২ সপ্তাহের মধ্যে করোনাভাইরাসের ‘ঢেউ উল্টোপথে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হবে ব্রিটেন। আগামী তিনমাসের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পুরোপুরি শেষ হতে অনেক সময় বাকি। সম্ভবত কয়েকবছর পর্যন্ত লাগতে পারে।

উপসংহার
বাংলাদেশের জনগন সহজ সরল অতি আবেগী লড়াকু মনোভাবসম্পন্ন জনগোষ্ঠী হিসেবে বিভিন্ন সংকটকালীন সময়ে প্রতীয়মান হয়েছে। বিশ্বের একমাত্র জাতি হিসেবে নিজ ভায়ায় কথা বলার অধিকার আদায়ে জীবন দিয়েছে। মাত্র ৯ মাস একরকম নিরস্ত্র অবস্থায় প্রতিপক্ষের অত্যাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত সেনাদের সাথে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসটি যদিও একটি অদৃশ্য বস্তু। তবে নিজেদের অমূল্য জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় সর্তকতা গ্রহণ, সরকারের প্রশাসনিক নির্দেশ, সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন-যাপন, গুজব পরিহার, রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকলে প্রয়োজনীয় সব কিছু করার চেষ্টাই বাংলাদেশীদের এ মরনযুদ্ধে জয়ী করবে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক দর্পণ প্রতিদিন। ১ এপ্রিল ২০২০।