বেঁচে থাকা- বিপন্ন বিস্ময়ে

বাংলাদেশ, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড বা যুক্তরাষ্ট্র- পৃথিবীর যে দেশেই জন্ম হোক না কেন, প্রত্যেক মানুষের অবচেতনে একজন ‘আউটসাইডার’ বাস করে। চলতি বাংলায় এই মানুষটিকে বলা যায় ‘বিবাগী’। প্রেমেন্দ্র মিত্র আলবেয়ার কামুর উপন্যাস ‘আউটসাইডার’ অনুবাদ করতে গিয়ে মানুষটিকে বলেছেন ‘অচেনা’। মানুষটি আমাদের খুব চেনা। কিন্তু কখনও কখনও তাকে মনে হয় অচেনা। ঘর-সংসার করে, বিষয়সম্পত্তির তদারক করে, ছেলেমেয়ের বিয়ে দেয়; কিন্তু এসবের পরেও লোকটাকে মনে হয় এক ভিন্ন ভুবনের মানুষ। ও আমাদের জীবনে আছে, কিন্তু থেকেও নেই। মানুষটি যদি পরপারে চলে যায়, আমাদের অনেকের উপলব্ধি হয় যে, তাকে আমরা শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি চিনতে পারিনি। তাকে আজীবন ঘিরে ছিল এক ধরনের দুর্ভেদ্য রহস্যময়তা।

অনেকে লেখক-শিল্পীদের এসব মানুষের দলে ফেলেন। এটা ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায় হয়তো। কারণ সাহিত্য ও শিল্পকলার ইতিহাসে দেখা গেছে উদাস-উদাস সৃজনশীল মানুষদের এক বড় অংশ পুরোপুরি বৈষয়িক। আর দশজন মানুষের মতো এরাও জমিজমা করেন, ব্যবসায় পুঁজি খাটান, মামলা-মোকদ্দমাও করেন কেউ কেউ। আবার সৃজনকর্মের এক আশ্চর্য রসায়নের কারণে এদের চরিত্র, বিশেষ-বিশেষ অনুভূতি এবং জীবন সম্পর্কে শেষ কথা এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’-এ জারিত। বাংলা কথাসাহিত্য ও কবিতার বিষয় যদি ধরি, কার রচনায় ‘আউটসাইডার’-এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব নেই? বিশ শতকে শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ (বন্দ্যোপাধায়), মানিক- কার রচনায় দুর্জ্ঞেয় এবং রহস্যঘেরা মানুষটি নেই? শ্রীকান্ত আপাদমস্তক বোহেমিয়ান, বিভূতিভূষণের অপু সংসারে থেকেও নেই, তারাশঙ্করের ‘কবি’ বা ‘নাগিনীকন্যা’ ঘর বাঁধার প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শশী ডাক্তার বা হোসেন মিয়া পাঠকের কাছে বিক্ষুব্ধ প্রহেলিকা হয়েই থাকল দুটি উপন্যাসে। রবীন্দ্রনাথ শেষদিকে ‘শেষের কবিতা’য় অমিত এবং লাবণ্যের ভেতর আধুনিক জীবনের আউটসাইডার-এর ছায়া রোপণ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আমাদের কাছে পরিস্কার হয়নি। জনপ্রিয়তার ডামাডোলে তার সাহিত্য প্রতিভাকে এক সময় ম্লান মনে হলেও, বাংলা সাহিত্যে ‘বিবাগী’ চরিত্রের জনক মূলত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এসব চরিত্র আমাদের চারপাশে জীবন্ত বা জীবন্মৃত হয়ে আছে একবিংশ শতকেও।

পাশ্চাত্যে ফরাসি লেখকদের অনেকে ‘বিবাগী’র জীবন যাপন করে গেছেন। এদের কেউ কেউ সাহিত্যে আবির্ভূত হন বিশ শতকী সাহিত্যের অব্যবহিত আগে। প্রথমেই ধরা যাক শার্ল বোদলেয়ারের কথা। প্রায় সারাজীবন ‘খারাপ’ পাড়ায় কাটিয়ে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন তিনি। তার পর ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেন আধুনিক বিশ্বকবিতার অন্যতম প্রধান এই কবি।

সংসার জীবন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্নই ছিলেন বোদলেয়ার। জঁ আর্তুরর্ যাঁবো, ভেরলেন প্রমুখ বাস্তব জীবনে প্রায় একই ধারার কবি। প্রথাগত অর্থে এরা ছিলেন ‘সমাজবহির্ভূত’। এদের তুলনায় ভ্যান গগ বা গ্যগাঁর মতো দু’একজন ছাড়া, ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি চিত্রকররা ছিলেন অনেক বাস্তবানুগ ও বৈষয়িক। অবশ্য এদের চিত্রকর্ম ছিল অতিবাস্তবতার প্রান্ত ছোঁয়া এবং দুঃসহ রকমের রোমান্টিক। কারও কারও ক্যানভাস ছিল আপাতঃপারম্পর্যহীন ইমেজ ও চিত্রকল্পে ঠাসা। এক্ষেত্রে পরবর্তী দশকে স্পেনীয় চিত্রকররা আটপৌরে বাস্তবতাবিরোধী শিল্প তৎপরতার শিখরে পৌঁছাবার চেষ্টা করেছেন। যেমন সালভাদর দালি। তারা একটা শিল্প-আন্দোলন শুরু করেন, যাকে আমরা এখন জানি ‘পরাবাস্তববাদ’ হিসেবে। এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে সাহিত্যেও, প্রথম মহাযুদ্ধের বেশ কয়েক বছর পর। এদেরও অধিকাংশের জন্ম ফ্রান্স ও স্পেনে।- এবং প্রায় সবাই কবি। চিরাচরিত রীতির বিরুদ্ধে যাপিত জীবনের ঝাপটা লেগেছিল ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র এবং লাতিন আমেরিকায়। এসব কবি-শিল্পী সমাজের মূল ধরে একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। কামিংস, টিএস এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, ইয়েটস বা অডেনের মতো ইংরেজিভাষী ব্রিটিশ-আইরিশ কবিদের মতো মার্কিন মুলুক দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন বিট জেনারেশনের গিন্‌সবার্গ, ফার্লিংহেটি, গ্রেগরি করসো প্রমুখ কবি। সময়টা ছিল পঞ্চাশের দশক। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকা মাতিয়ে রাখলেন স্পেনীয় ভাষার কবিরা, যাদের মধ্যে দুটি নাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য- পাবলো নেরুদা এবং খেসাব্‌ বাইয়েহো। লাতিন আমেরিকার স্পেনীয় ভাষার কবিদের গোড়া ছিল অবশ্য স্পেনের মাদ্রিদ। ওই ঐতিহাসিক শহরে কবিজন্ম লাভ করেন লোরকা, মাচাদো, আলবের্তি প্রমুখ কবি।

জনসংলগ্ন থেকেও নির্জন এবং বৈরাগ্যপ্রবণ চরিত্রটি ধরে রাখার প্রবণতা আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করি স্প্যানিশ কবিতায়। একমাত্র পাবলো নেরুদা ছাড়া, স্পেনীয়ভাষী কবি এবং গদ্যকারদের অধিকাংশ ছিলেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। কেউ কেউ ভবঘুরে এবং হতদরিদ্র। আক্ষরিক অর্থেই সমাজের মূলধারা থেকে এরা ছিলেন বিচ্ছিন্ন। সংসার শুরু করেছিলেন এদের অনেকে, যা শেষ হয়েছে দাম্পত্য কলহ ও বিয়েবিচ্ছেদে। পরনারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন কেউ কেউ। ঔপন্যাসিকদের মধ্যে কারও কারও ছিল চূড়ান্ত মাত্রার গণিকাপ্রীতি। খুব কম গদ্যকারই মুক্ত ছিলেন মদ্যাসক্তি থেকে। কবিরাও কম যেতেন না। এসবের বিশদ বর্ণনা আছে পাবলো নেরুদার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘মেমোয়ার্স’ এবং গার্সিয়া মার্কেজের আত্মকথন ‘লিভিং টু টেল দ্য টেল’-এ।

লাতিন আমেরিকার কবি-গদ্যকারদের প্রায় সবাই ছিলেন একেকজন ‘আউটসাইডার’ বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের ভাষায় ‘অচেনা’। বাংলা লোকপুরাণ এসব মানুষকে বলেছে ‘বিবাগী’। লালন এদের বলেছেন ‘পাগল’। হাছন রাজার কল্পনায় এরা ঘর বাঁধে শূন্যে। বাংলার লোকসাহিত্য যেমন, এ অঞ্চলের আধুনিক সাহিত্য সম্ভারেও সফল কিন্তু মূলত একাকী মানুষের উঞ্ছবৃত্তি লক্ষ্য করা যায় প্রচুর। কারণ অনেক কবি-গদ্যকার নিজেরাই তাদের ভেতর লালন করেন ‘অচেনা’ সত্তাকে। এর যথার্থ দৃষ্টান্ত জীবনানন্দ দাশ। তাঁর বাহ্যিক এবং অন্তর্গত- উভয় জগৎই এক ব্যাখ্যাতীত একাকিত্ব বা নির্জনতায় পূর্ণ। আমজনতা এবং জীবনের বৈষয়িক ক্লেদ ও কোলাহল থেকে দূরে থাকার ফলে সংসার জীবনে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অসফল। তার ভুবন ছিল নিজের অন্তর্লোক, যার ভেতর ডুবে থাকার ফলে তিনি অনুভব করেন এক অদ্ভুত বোধকে। এ ছিল তার ‘বিপন্ন বিস্ময়’, যা অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে যায় নিরন্তর। পুরো আধুনিক বিশ্বকবিতায় এই ‘বোধ’ দৃষ্টান্তহীন। অনেকে জীবনানন্দের কবিতা ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করেছেন। কিন্তু এসব কাজ আক্ষরিক অনুবাদ। আজীবন বিপন্ন বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে থাকা এই বাঙালি কবির মনোভুবন রূপান্তরের অতীত; অনুবাদক তার পছন্দের ভাষায় যত পটুই হোন না কেন। এখানেই জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠত্ব বা অমরত্ব। রবীন্দ্রনাথের জগৎ বিশাল। একইভাবে বিস্তৃত তার অনুভবের মানচিত্র। কোনো কোনো মুহূর্তে তিনিও নিজেকে ‘বিবাগী’ বা ‘আউটসাইডার’-এর দলে ফেলেছেন। কবিতা বা গদ্যের চেয়ে তার অনেক গানে আমরা এর আভাস পাই। প্রায় একই কথা বলা যায় নজরুলের ক্ষেত্রেও। ব্যক্তিগত জীবনে জীবনানন্দ ও নজরুল দু’জনই লালনের ভাষায় সংসারে থাকা সন্ন্যাসী। কিন্তু দু’জনের জীবনযাপনের ধরন ছিল আলাদা।

আধুনিক বাংলা কবিতার আরেক কিংবদন্তিতুল্য পুরুষ শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তার বিশৃঙ্খল এবং ‘উপভোগ্যকর’ নৈরাজ্যময় জীবনকে দিয়ে অনেকে তাকে বিচার করেন এবং তার কবিতাকেও। সম্প্রতি প্রকাশিত কবির সঙ্গে তার সংসার জীবন নিয়ে লেখা স্ত্রী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের বইয়ে আমরা এক ভিন্ন শক্তিকে পাই। কবি আজীবন সংসার সংলগ্ন থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এক অপার্থিব হাতছানি তাকে নিয়ত বিচলিত রেখেছে। কবি সেই কুহকী আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেননি। স্ত্রী-সন্তান-গেরস্থালি নিয়ে পরম ভালোবাসায় গড়া সংসারের মায়া ছিন্ন করে ছুটে গেছেন তিনি অজানা কোনো আনন্দের আহ্বানে। পরনারী বা সুরা নয়; এ-হাতছানির উৎস সমস্ত বৈষয়িক নিগড় থেকে নিজেকে ছিন্ন করে মুক্তির ডানা মেলার আকাঙ্ক্ষা। স্ববিরোধিতা ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভেতর। অনিশ্চিত পর্যটনে এবং চূড়ান্ত আনন্দকে মরীচিকা হিসেবে আবিস্কার করে তিনি আবার ফিরে এসেছেন তার প্রিয় সংসারে। মীনাক্ষী নিজেও ছিলেন প্রায়-কবি, তাই এসব যথেচ্ছাচার সয়ে গেছেন দিনের পর দিন। কবির বইয়ের নাম ‘কেন ধর্মে আছি, জিরাফেও আছি’, তার ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারেন মীনাক্ষী।

শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদ সুশৃঙ্খল এবং সংযত জীবন কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু তারাও কি জীবনানন্দের মতো অপার্থিব হাতছানি পাননি? এ দু’জনের কোনো কোনো কবিতায় বৈষয়িক জীবনের সীমারেখা ছিন্ন করে নিজস্ব আনন্দলোকে নিজেকে সমর্পণ করার বাসনা উঠে এসেছে প্রবলভাবে। এদের মতো কবিতায় অবিচ্ছিন্নভাবে মনোযোগী ছিলেন না শহীদ কাদরী। লিখেছেন কম। কিন্তু উৎকর্ষের বিচারে সেগুলো অনবদ্য। তারও অজস্র কবিতায় তার ‘অচেনা’ সত্তাকে অনুভব করা যায় প্রবলভাবে।

কবি, গদ্যকার, চিত্রকর ছাড়াও সমাজে বহু মানুষ আছেন, যারা সংসারে থেকেও নেই। এরা ঘরের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করে যান নিঃশব্দে। কেউ কেউ হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে পড়েন। কেউ ফেরেন, কেউ ফেরেন না। অনেকে আবার ঘর-সংসার এবং বিষয়-আশয়ের পরিমণ্ডলেই থেকে যান আজীবন। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, কী দুঃসহ তাদের জীবন। নানা শৃঙ্খলে বাঁধা, কিন্তু বিপন্ন বিস্ময়ে আক্রান্ত মানুষের মতো অসুখী নর-নারী কমই আছে বিশ্বসংসারে। আমরা এসব মানুষকে চিনি। তাদের অন্তর্লোকে ঢোকার প্রয়োজন বোধ করি না।