শহীদ রাজুর সম্মানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে নির্মিত হয়েছে রাজু ভাস্কর্য
“ওরা তোমাকে যতই পুড়িয়ে ভস্ম করুক হিংসার আগুনে,
তুমি বারবার আগুন থেকে বেরিয়ে আসবে পুরাণের পাখি।”
বারবার পুনরুত্থানের ক্ষমতায় বলীয়ান গ্রিক পুরাণের সেই পাখিটিকে এক তরুণের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান। কবি তার কবিতায় শোকগাঁথা লিখেছিলেন যার মৃত্যুতে, মঈন হোসেন রাজু সেই তরুণের নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার সময় রাজুর কাঁধে যে ব্যাগটি ছিল তার মধ্যে থাকা একটি নোটবুকের অনেকগুলো পাতায় চারটি পঙক্তি বার বার লেখা ছিল-
“অবশেষে সব কাজ সেরে
আমাদের দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাবো আশীর্বাদ
তারপর হবো ইতিহাস”
শেষ লাইনটাতে কখনো “হব” আবার কখনো “হবো” লিখেছিলো রাজু। শব্দের বানান নিয়ে রাজুর সংশয় ছিলও হয়ত, কিন্তু নিজে “ইতিহাস” হওয়া নিয়ে কোনো সংশয় ছিলো কি তার? ২১ বছর বয়সে যে কবির কবিতার কলম চিরতরে থমকে যায় ব্যাধির কাছে সে কবিও কি জানতো নিজের ভবিতব্য? ২১ এর সুকান্তের জীবনের সাথে ২৩ এর মঈন হোসেন রাজুর জীবনাবসানের হয়ত কোনো মিল নেই কিন্তু জীবনের মিল ঠিকই ছিলো। জীবন দিয়ে সমাজ বদলের জন্য মরিয়া ছিলেন দুজনই। রাজু কি সুকান্তকে অনেক বেশি পড়েছিল ততদিনে! ছয় বছরের বড় সহোদর মুনীম হোসেন রানার স্মৃতিতে রাজুকে আবিষ্কার করি বই পাগল, পাখিপ্রেমী, কোমল হৃদয়ের তরুণ রূপে। তারুণ্যে অমন সাহসী মৃত্যু যুগের পর যুগ বহু তারুণ্যকে প্রেরণা যোগাবে, এমন স্বপ্নই তো দেখেছিলেন শামসুর রহমান রাজুকে নিয়ে লেখা কবিতায়—
“যে-তোমাকে কবরে নামিয়েছি বিষণ্ণতায়, সে নও তুমি।
প্রকৃত তুমি ঐ মাথা উঁচু ক’রে আজও নতুন সভ্যতার আকর্ষণে
হেঁটে যাচ্ছ পুঁতিগন্ধময় গুহা-কাঁপানো মিছিলে,
তোমার অঙ্গীকার-খচিত হাত নীলিমাকে স্পর্শ করে
নিঃশঙ্ক মুদ্রায়”
বাসায় সবাই তাকে ডাকতো “বাবু” বলে। বই পড়ার তীব্র ঝোঁক ছিল স্বভাবে চুপচাপ বাবুর। বড় ভাই রানার ভাষ্য, “সেভেনে ওঠার পর ওর মধ্যে কিছু পরিবর্তন আসে। রাজনৈতিক সচেতনতা, নিজের আদর্শগত জায়গা, নেতৃত্ব গুণ লক্ষ করতাম।” স্কুলপড়ুয়া রাজু জড়িয়ে পড়ে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তেজগাঁও কলেজে ভর্তি হয়েও ছাত্র ইউনিয়নর সঙ্গে রাজুর সম্পর্ক অটুট থাকলো।
স্বৈরাচার পতনের লড়াই এর মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয় রাজু। কিছুদিনের মধ্যেই নিজ সংগঠনের কর্মী হিসেবে রাজু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হতে থাকে। প্রথমে সংগঠনের শহিদুল্লাহ হল কমিটির সদস্য, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং ১৯৯১ সালে ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন মঈন হোসেন রাজু।
৯০-এ স্বৈরাচার পতনের পর ক্যাম্পাসগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরে আসার বদলে পাল্টাপাল্টি সন্ত্রাস আর দখলদারিত্বের থাবায় তখন বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে শিক্ষাঙ্গন। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে বিপর্যস্ত শিক্ষাঙ্গনে তখন গড়ে ওঠে “গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য” নামে একটি জোট।
১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ঘটনার দিন ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদলের নেতা কর্মীদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের মধ্যেই তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়েই মিছিল শুরু করেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজু। অস্ত্রের হুঙ্কারের মাঝেই সে মিছিল থেকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাহসী স্লোগান আছড়ে পড়ে টিএসসির দেয়ালগুলোতে। তাদের ১০-১২ জনের মিছিলটি টিএসসির পূর্ব গেট ধরে ডাস চত্বর ঘুরে যতক্ষণে হাকিম চত্বরের পাশ দিয়ে বর্তমান রাজু ভাস্কর্য ঘুরে টিএসসিতে অবস্থান নেয় ততক্ষণে বিশাল আকার ধারণ করেছে তা। এরপর সেই মিছিল আবার ঘুরে টিএসসি’র পশ্চিম দিকের সিঁড়িঘরের সামনে এসে থামে এবং বক্তব্য শুরু হয়।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে আবার গোলাগুলি এবং সাথে সাথে আবারো প্রতিবাদের মিছিল-স্লোগানে প্রকম্পিত ক্যাম্পাস। সেই মিছিলেই হঠাৎ এক রাউন্ড গুলি এসে বিদ্ধ হয় রাজুর মাথায়। পুরো ক্যাম্পাসকে কাঁদিয়ে রাত দশটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
২০১৬ সালে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু দিবসে ছাত্র ইউনিয়নের র্যালি। ছবি: জাহিদুল ইসলাম সজীব
শহীদ রাজুর সংগ্রামকে ধারণ করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে নির্মিত হয় “সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য”। দীর্ঘদিনের চড়াই-উৎরাই পেরিয়েএই ভাস্কর্য নির্মাণের অনুমতি পায় ছাত্র ইউনিয়ন। এর নকশা ও নির্মাণেছিলেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী। সার্বিক দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ কে আজাদ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন। রাজুর স্মরণে টিএসসি’র ডাস চত্বরের একপাশে রয়েছে রাজুর একটি প্রতিকৃতি, যেখানে প্রতিবছর, ১৩ মার্চ রাজু দিবসেরাজুর স্মৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
মূলতঃ রাজুর বড় ভাই মুনীম হোসেন রানা এবং ছাত্র ইউনিয়নের তার সহযোদ্ধা শাহানা আক্তার শিলু, সাঈদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উৎপল চন্দ্র রায় ও গোলাম কিবরিয়া রনির অবয়বকে সামনে রেখে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রাজু ভাস্কর্যের অবয়ব।
রাজুর গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিতে ফুল ছিটিয়ে শ্রদ্ধা জানায় সহযোদ্ধারা। (১৯৯২) ছবি সংগ্রহ: মুনীম হোসেন রানা; (মঈন হোসেন রাজুর বড় ভাই)রাজুকে স্মরণীয় করে রাখতে আট জন তরুণ-তরুণীর আদলে তৈরি ভাস্কর্যের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আজো ছাত্র-তরুণরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, আজো সেখানে সাহসী মানুষেরা জড়ো হয় নিজ নিজ দাবি নিয়ে। কিন্তু রাজুকে তারা ক’জন চেনে! ক’জন জানে ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চের পড়ন্ত বিকেলে যখন রক্তিম সূর্য গোধূলির কোলে আশ্রয় নিচ্ছে তখন ২৩ বছরের এক টগবগে তরুণ ঠিক মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ছে সাথীদের কোলে! ইতিহাস বিস্মৃত হওয়া আমাদের দেশের জন্য নতুন কিছু নয়। হুমায়ুন আজাদ বাঙালীকে নিয়ে বলেছিলেন, “…সফল হওয়ার পর মনে থাকে না কেন তারা আন্দোলন করেছিল।” তাই আন্দোলনে প্রাণোৎসর্গকারীদের মনে রাখা তো আরো দূরহ কাজ আমাদের জন্য। কিন্তু রাজুকে চেনে না এমন বহু তরুণও রাজুর স্মৃতিতে নির্মিত ভাস্কর্যের পাদদেশে এসে দাঁড়ায় নিজ নিজ অধিকারের দাবিতে। বহু রাজু এখান থেকেই শপথ নেয় অন্যায়কে রুখে দেওয়ার। বাংলাদেশের তারুণ্যের অন্যতম সেরা প্রতিচ্ছবি এই “সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য”।
রাজুর মৃত্যুতে লেখা শামসুর রহমানের কবিতা পুরাণের পাখি:
পুরাণের পাখি
শামসুর রহমান
না রাজু, তোমাকে আমরা ঘুমোতে দেব না।
এই যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তোমার শিয়রে
প্রতারিত, লুণ্ঠিত মানুষের মতো,
আমাদের মধ্যে কেউ এমন নেই যে তোমাকে
ঘুমোতে দেবে।
জেগে থাকতেই ভালবাসতে তুমি
এই নিদ্রাচ্ছন্ন দেশে; অন্ধকারে দু’টি চোখ সর্বক্ষণ
জ্বলত পবিত্র দীপশিখার মতো,
সেই চোখে আজ রাজ্যের ঘুম।
না রাজু, তোমার এই ভঙ্গি আমাদের প্রিয় নয়,
এই মুহূর্তে তোমার সত্তা থেকে
ঝেড়ে ফেলো নিদ্রার ঊর্ণাজাল।
তোমার এই পাথুরে ঘুম আমাদের
ভয়ানক পীড়িত করছে;
রাজু, তুমি মেধার রশ্মি-ঝরানো চোখ মেলে তাকাও
তোমার জাগরণ আমাদের প্রাণের স্পন্দনের মতোই প্রয়োজন।
দিনদুপুরে মানুষ শিকারীরা খুব করেছে তোমাকে।
টপকে-পড়া, ছিটকে-পড়া
তোমার রক্তের কণ্ঠস্বরে ছিল
পৈশাচিকতা হরণকারী গান। ঘাতক-নিয়ন্ত্রিত দেশে
হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলে তুমি,
মধ্যযুগের প্রেতনৃত্য স্তব্ধ করার শুভ শ্লোক
উচ্চারিত হয়েছিল তোমার কণ্ঠে,
তোমার হাতে ছিল নরপশুদের রুখে দাঁড়াবার
মানবতা-চিহ্নিত প্রগতির পতাকা
তাই ওরা, বর্বরতা আর অন্ধকারের প্রতিনিধিরা,
তোমাকে, আমাদের বিপন্ন বাগানের
সবচেয়ে সুন্দর সুরভিত ফুলগুলির একজনকে,
হনন করেছে, আমাদের ভবিষ্যতের বুকে
সেঁটে দিয়েছে চক্ষুবিহীন কোটরের মতো একটি দগদগে গর্ত।
শোনো, এখন যাবতীয় গাছপালা, নদীনালা,
ফসলের ক্ষেত, ভাসমান মেঘমালা, পাখি আর মাছ-
সবাই চিৎকারে চিৎকারে চিড় ধরাচ্ছে চরাচরে, ‘চাই প্রতিশোধ।‘
নক্ষত্রের অক্ষর শব্দ দু’টি লিখে দিয়েছে আকাশে আকাশে।
যে-তোমাকে কবরে নামিয়েছি বিষণ্ণতায়, সে নও তুমি।
প্রকৃত তুমি ঐ মাথা উঁচু ক’রে আজও নতুন সভ্যতার আকর্ষণে
হেঁটে যাচ্ছ পুঁতিগন্ধময় গুহা-কাঁপানো মিছিলে,
তোমার অঙ্গীকার-খচিত হাত নীলিমাকে স্পর্শ করে
নিঃশঙ্ক মুদ্রায়,
ওরা তোমাকে যতই পুড়িয়ে ভস্ম করুক হিংসার আগুনে,
তুমি বার বার আগুন থেকে বেরিয়ে আসবে পুরাণের পাখি।
লাকী আক্তার
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
*****************************************************************************************************************
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।