মান্না দে'র অনিন্দ্য জীবন ভুবন

উপমহাদেশের প্রবাদপ্রতিম সংগীতশিল্পী মান্না দে। বাংলা, হিন্দি ছাড়াও অসমিয়া, মারাঠি, মালয়ালম, কনড় প্রভৃতি ভাষায় অনেক গান গেয়েছেন তিনি। মান্না দে গায়ক হিসেবে ছিলেন আধুনিক বাংলা গানের জগতে সর্বস্তরের শ্রোতাদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ও সফল সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব। সঙ্গীত জীবনে তিনি সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেন। সঙ্গীত ভুবনে তার এ অসামান্য অবদানের কথা স্বীকার করে ভারত সরকার তাকে ১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী, ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ২০০৭ সালে দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননায় অভিষিক্ত করে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ প্রদান করে।

আধুনিককালের বাঙালি জীবনের প্রায় সর্বস্তরে বহুল চর্চিত গানের বরেণ্য এই শিল্পীর জীবনবোধ-চিন্তা-চেতনা নিয়ে সম্প্রতি ‘মান্না দে :শিল্পীর চেয়েও যিনি বড় মানুষ’ নামে গ্রন্থ রচনা করেছেন লেখক শরাফত আলী, যা এবারের একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়।

গান শোনার সময় যার গান ভালো লাগে, আমরা তাকেই বড় শিল্পী বানিয়ে দিই। সাধারণ মানুষের কাছে বড় শিল্পী তিনিই, যিনি অন্য শিল্পীকে প্রভাবিত করতে পারেন, অনুরণন সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারেন। মান্না দে এমনই একজন শিল্পী ছিলেন। তার জীবনবোধের বিভিন্ন দিক এই বইয়ে পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন লেখক।

মান্না দে’কে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেখক নিজের শৈশব-কৈশোর জীবনের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। যেখানে তার সংস্কৃতিমনা জীবনের প্রকাশ আমরা পেয়ে থাকি। বইয়ের প্রথম অংশে যেমন তিনি লিখেছেন, যৌবনে যে কিশোরীর সাথে প্রেম করেছি তার সাথে কত বছর যে সারারাত গান শুনে কাটিয়েছি তা হিসেবে নেই। অন্যান্য চাহিদা হয়তো কিছু সময়ের। কিন্তু সংগীতের আবেদন তো চিরকালীন।

বইয়ে মান্না দে প্রসঙ্গে পাঠক বেশ কিছু তথ্য পাবেন, যা পাঠকহৃদয়কে আলোড়িত করবে নিঃসন্দেহে- ‘জীবনে মান্না দে কখনো গায়ক হতে চাননি। পরিবার চায়নি। মান্না দে নিজে যে কী হতে চেয়েছিলেন, সে এক ধাঁধা। তবে পরিবার চেয়েছিল, তিনি ব্যারিস্টার হন। হাওড়ার সিমলাপাড়ার দুরন্ত কিশোর প্রবোধ চন্দ্র দে ওরফে মান্না। মান্না দে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রথাগত গানবাজনার তালিম কখনও নেননি। বাড়িতে যে পরিবেশ সেটাই তাকে হয়তো অবচেতনে উৎসাহিত করেছিল।’ গানের বাইরেও মান্না দে’র বৈচিত্র্যময় জীবনের তথ্য খুঁজে পাই লেখকের লেখনীতে। বইয়ে মান্না দে’র রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীত ভাবনাও এসেছে সুচারুভাবে। শিল্পী মান্না দে’র বাইরেও ব্যক্তি মান্না দে’র শৈশব থেকে নিয়ে তারকা হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন অজানা তথ্য পাঠক জানতে পারবেন এ বই থেকে।

বাবা পূর্ণ চন্দ্র ও মা মহামায়া দে’র সন্তান মান্না দে ১ মে ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মায়ের সংস্পর্শ ছাড়াও পিতৃসম্বন্ধীয় সর্বকনিষ্ঠ কাকা সঙ্গীতাচার্য (সঙ্গীতে বিশেষভাবে দক্ষ শিক্ষক) কে.সি. দে (কৃষ্ণচন্দ্র দে) তাকে খুব বেশি অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেছেন। মান্না দে তার শৈশবের পাঠ গ্র্রহণ করেছেন ‘ইন্দু বাবুর পাঠশালা’ নামে একটি ছোট প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল এবং স্কটিশ চার্চ কলেজে স্নাতক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যয়নকালীন তিনি তার সহপাঠীদের গান শুনিয়ে আসর মাতিয়ে রাখতেন। তিনি তার কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে ও ওস্তাদ দবির খানের কাছ থেকে গানের শিক্ষা লাভ করেন। ওই সময় মান্না দে আন্তঃকলেজ গানের প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিকভাবে তিন বছর তিনটি আলাদা শ্রেণিবিভাগে প্রথম হয়েছিলেন।

বইটি থেকে জানা যায়, পরবর্তী জীবনে তিনি গান গেয়ে বিখ্যাত হলেও প্রথম দিকে খেলাধুলাতে বেশ আগ্রহ ছিল। যৌবনে কুস্তি, বক্সিংয়ের মতো খেলায় পারদর্শী ছিলেন মান্না দে। তা ছাড়া ফুটবলও খেলতেন তিনি। সংগীত জগতে আসবেন, না আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করবেন- এ নিয়েও নাকি দ্বন্দ্ব্ব ছিল মান্না দে’র মনে। তবে কাকা কৃষ্ণচন্দ্র চাইতেন ভাইপো গান করুক। প্রথমে কাকা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে গানের তালিম নেওয়া শুরু করলেও পরে একাধিক জনের কাছে তিনি তালিম নেন। ওস্তাদ আমান আলি খান ও ওস্তাদ আব্দুর রহমান খানের কাছ থেকে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নেন তিনি। দুর্লভ কিছু ছবির পাশাপাশি ১৯৪২ হেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত মান্না দে’র গাওয়া গানের একটি দুর্লভ তালিকা বইটিতে পাওয়া যায়, যা পাঠকদের জন্য সংগ্রহে রাখার মতো বিষয় হতে পারে। সর্বোপরি পাঠক মান্না দে সম্পর্কে নতুন একটি দিগন্তের সন্ধান পাবেন ‘মান্না দে শিল্পীর চেয়েও যিনি বড় মানুষ’ বইটি পড়ে। লেখক শরাফত আলীর অক্লান্ত শ্রম ও মান্না দে’র প্রতি তার নিবিড় ভালোবাসার স্পর্শ জড়িয়ে আছে বইটির প্রতিটি পাতায়। বর্ষাদুপুর প্রকাশনী থেকে এবারের বইমেলায় ‘মান্না দে :শিল্পীর চেয়েও যিনি বড় মানুষ’ প্রকাশিত হয়েছে।