আমি ক’দিন ধরে নারী দিবস নিয়ে নানাজনের নানা লেখা পড়লাম। ব্যক্তিগতভাবে নারী দিবসের পক্ষে আমি নই। আমার কথা হচ্ছে- নারীর জন্য কেন আলাদা দিবস! যদি নারীর জন্য আলাদা দিবসই হয় পুরুষের জন্য নয় কেন? পুরুষ নারী সমতার প্রশ্নই যদি আসে তাহলে আলাদা দিবসে কোনো প্রয়োজন নেই। সব দিনই নারী পুরুষের জন্য সমান। দিবস আলাদা করা মানে নারীকে আলাদা করা।

অন্য দিবসে নারী যেমন ঘর সামলায়, সন্তান সামলায়, রান্না বান্না করে, সাজগোজ করে, স্বামীসেবা করে এই দিবসেও তাই করে। শ্রমজীবী নারী যেমন ইট ভাঙে এ দিবসেও ভাঙে। কর্মজীবী নরী যেমন অফিসে ছোটে এ দিবসেও ছোটে। এমন নয় যে এ দিবসে পুরুষ তার রান্নাটা করে দেয় বা বাচ্চাটা সামলায়। বা এ দিবসে ইট না ভাঙলে ইট শ্রমিকের পেট চলে। বা কর্মজীবী নারী অফিস না করলে তার বেতন কাটা পড়ে না। তার সহকর্মী বা পুরুষ বস বলেন, আজ আপনার কাজটা আমি করে দিচ্ছি। তাতো নয়। অন্য দশটা দিন যেমন নারীকে কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়, এদিনও তেমন। যে পুরুষরা নারীকে সাহায্য করে তারা অন্যদিনও করে এদিনও করে। যে বস সহানুভুতিশীল সে অন্যদিনও যেমন এদিনও তেমন। যে বন্ধু সহৃদয় সে অন্যদিন যেমন এদিনও তেমন।

আর এমন নয় যে, এই দিবসটিতে নারীর উপর কোনো নির্যাতন, কোনো সহিংসতা হয় না। এদিনে নারী ধর্ষিত হয় না, নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় না বা লাঞ্ছিত হয় না। এই একটা দিনে সারা পৃথিবীর নারীরা শঙ্কামুক্ত থাকে, সম্মানের সঙ্গে থাকে। মোটও তা নয়।
তা যখন নয় কেন এই নারী দিবস? নারীর উপার্জনে তার অধিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তার মতামত গ্রহণ এসব কোনো দিবস দিয়ে হয় না। দিবস দিয়ে লোক দেখানো শুভেচ্ছা, অভিনন্দন পোস্ট এসব হয়। নারীর ভাগ্য তাতে ফেরে না।

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থটি পড়লাম। বলতে দ্বিধা নেই, আমার পড়া শ্রেষ্ঠ বইগুলোর একটি এটি। ১৯৪৩ সালে শান্তি সম্মেলনে চীনে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, চীনে পুরুষ নারী সমভাবে কাজ করে। সমান মর্যাদা পায়। ব্যতিক্রম সবদেশে সবখানে আছে। কিন্তু বৃহত্তর সংখ্যাটিই বিবেচ্য। আমাদের দেশে নারী সচিব, নারী জজ থেকে শুরু করে নানান গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী আছেন। রাষ্ট্রপ্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী স্পিকার নারী। বেশ কিছু নারী উদ্যোক্তা সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এতে কি বলা যাবে এ দেশটি সম্পূর্ণ নারীবান্ধব। সরকার প্রধানের চিন্তা ও সদিচ্ছার কোনো কমতি নেই। কিন্তু তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সমভাবে যে নারীর উন্নয়ন  হচ্ছে না। হচ্ছে না পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন। তাই এখনই প্রতিদিন শিক্ষক দ্বারা, আইন শৃঙ্খরা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নারীর ইজ্জত লুণ্ঠিত হতে দেখছি। নুসরাতের মতো মেয়েরা জীবন দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাহলে এই নারী দিবসের তাৎপর্য কী, কতটা? এ প্রশ্ন এসেই যায়।

নারীর অবস্থার যে পরিবর্তন যে হচ্ছে না এর দায় নারীরও কিছু কম নয়। পাপিয়ার মতো কতিপয় নারী আছে যারা পুরুষের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠে। তাদের লোভ লালসা নানান উপায়ে আর নারী জাতিকে করে কলঙ্কিত। পুরুষের কলঙ্ক, ঘুষ দুর্নীতি সমাজে যতটা চাউর হয় নারীর হয় তার শতগুণ। তাই নারী পদে পদে ধিকৃত হয়। যারা এই নারীদের ব্যবহার করে তারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তাই নারীদিবস, নারী দিবসের চটকদার স্লোগান, ফেস্টুন, ব্যানার, টিসার্ট, ঘোড়ার গাড়িতে আসলে নারীর প্রকৃত অস্থা প্রতিফলিত হয় না। নারীর অবস্থানগত উন্নয়নের কোনো প্রমাণ এই ফেস্টুন স্লোগান নয়।  

একটা জিনিস ভাবতে অবাক লাগে, আমার ছেলেবেলায় দেখেছি মা আব্বাকে আপনি বলতেন। তখনকার দিনে অধিকাংশ বাড়িতে স্ত্রীরা স্বামীকে আপনি বলতেন। কিন্তু স্বামীরা স্ত্রীদের যথেষ্ট সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। সাধ্যমতো তাদের কোনো চাওয়াই অপূর্ণ রাখতেন না। তখন এখনকার মতো নারীরা স্বাবলম্বী ছিলেন না। তেমন শিক্ষিতও ছিলেন না। ঘরকন্যাই করতেন। বাবা মায়ের পছন্দেই বিয়ে হতো। তারপরও কত সুখী ছিলেন তারা। এত ডিভিার্স ছিল না। বউ পেটানোর কথা কি ধনী কি দরিদ্র কারো ঘরেই শুনিনি। পারিবারিক কারণে আত্মহত্যার কথাও শুনিনি। অনেকে হয়ত বলবেন, স্ত্রীর কোনো ভয়েস ছিল না তখন যা বলত স্ত্রীরা তাই মেনে নিতেন বলে বিরোধ হতো না। এ কথাও মানতে পারছি না। আমার মাকে দেখেছি সংসারের প্রতিটি ব্যাপারে মতামত দিতে। আর আব্বা সেগুলো মেনে নিয়েছেন। যেগুলো মানেননি কেন মানতে পারছেন না বুঝিয়ে বলেছেন। মা সে যুক্তি মেনে নিয়েছেন।

তাহলে এত বছর পর, এত উন্নয়নের পর কেন এমন দশা হলো। কেন ঘরে ঘরে অশান্তি, সুইসাইড, ডিভোর্স। এর একটা কারণ হতে পারে, নারী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে, অফিস আদালতে কাজ করছে। তার ঘরের সময় কমে যাচ্ছে। যে সময়টা কম পড়ছে সেটা যদি স্বামী স্ত্রী মিলিয়ে পুষিয়ে দেয় তাহলে সমস্যা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। পুরুষ আগের মতোই চাইছেন বাদশাহি বোর চালে থাকতে। চাইছেন অফিস ফেরত স্ত্রী তাকে ধূমায়িত চায়ের কাপ এগিয়ে দেবে। তিনি ভাবছেন না, স্ত্রীও তো অফিস করে এলেন।

অনেক খারাপ নারীও আছেন। তাই একপেশে বললে হবে না। সাজসজ্জা নিয়ে ব্যস্ত থাকে না, মোবাইল ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান স্বামী বা সংসারের দিকে ন্যূনতম নজর দেন না এমন স্ত্রীও আছেন। কোনো কোনো স্ত্রী স্বামীকে দিয়ে রান্না করিয়ে নেন। মারধোরও করেন বলে শুনেছি। স্বামী লজ্জায় বলতে পারেন না। তাই সমাজে যে শুধু নারীই নির্যাতিত হয় এমনটা নয়, পুরুষ নির্যাতনও হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তবে নারী নির্যাতন নিঃসন্দেহে বেশি।

যৌথ পরিবারে নারীকে স্বামী না দেখলেও অন্যরা দেখার ছিল। দেখত কি দেখত না সেটা পরের কথা। কিন্তু ছিল। কিন্তু এখন এই নিউক্লিয়ার পরিবারে স্ত্রী যদি স্বামীর নির্যাতনে মারাও যায় দেখার কেউ নেই। আর সমাজটা এখন এমন হয়েছে যে প্রতিবেশি শব্দটা অভিধানে আছে, কাজে নেই। আগের দিনে প্রতিবেশি ছিল আত্মীয়ের চেয়ে বেশি। আপদে বিপদে তারাই ছুটে আসত সবার আগে। কোথায় হারালে সেই সোনালী দিনগুলো।

দাও ফিরেয়ে অরণ্য বললে আমরা আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারব না। ফেরা উচিতও নয় । কারণ শিক্ষা দীক্ষা জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। সেই অগ্রযাত্রায় পুরুষের পাশিপাশি নারীরও সামিল হওয়া প্রয়োজন। তাই নারীকে এগুতেই হবে। শুধু দরকার পুরুষ নারী উভয়েরই উদারতান্ত্রিক মনোভাব, মানবিকতাবোধ, পরস্পরকে সমান ভাবার মানসিকতা। আর দরকার নারীবান্ধব শুধু নয়, মানববান্ধব পরিবেশ।