বঙ্গবন্ধুর উন্মেষপর্বে তিনি ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসাবে খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ‘রাজনৈতিক শিষ্য’ ছিলেন, যিনি সব সময়ই বাম ধারার সমাজতান্ত্রিক মতবাদের শরিক। একই সঙ্গে তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন  মুসলিম লিগের দার্শনিক নেতা আবুল হাসিমের ক্লাস সম্পর্কে। তিনি লিখছেন- ‘আমার সহকর্মীরা অধিক রাত পর্যন্ত তার আলোচনা শুনতেন। আমার পক্ষে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কষ্টকর। কিছু সময় যোগদান করেই ভাগতাম। আমি আমার বন্ধুদের বলতাম, ‘তোমরা পণ্ডিত হও, আমার অনেক কাজ। আগে পাকিস্তান আনতে দাও, তারপর বসে বসে আলোচনা করা যাবে।’ কাজেই তাত্ত্বিক তিনি ছিলে না ঠিকই, কিন্তু তাত্ত্বিক না হলেও বঙ্গবন্ধুর সুনির্দিষ্ট কিছু আদর্শ ছিল, মূল্যবোধ ছিল, লক্ষ্য ছিল। মাত্র তিনটি বাক্যেই বঙ্গবন্ধু তার আত্মপরিচিতি ও মূল্যবোধ অত্যন্ত পরিষ্কার করেছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখছেন – ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্প্রীতির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে’। এই আত্মপরিচয় থেকেই আমরা উপলব্ধি করতে পারি তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার চারটি বৈশিষ্ট্য: বাঙালি জাতিসত্তা, জনসম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সমাজতন্ত্র।

কিন্তু ধাক্কা তিনি খেলেন তার সূচনাপর্বে। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন সে সময় জনসভায় পাকিস্তান আন্দোলনকে তিনি উত্থাপিত করতেন লাহোর প্রস্তাবের ধারণায়, দুটি মুসলমান প্রধান সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে:

‘পাকিস্তান দুইটা হবে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা পশ্চিম পাকিস্তান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে—পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্দু প্রদেশ নিয়ে।’ তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এই ভেবে যে এই নতুন রাষ্ট্রে দরিদ্র মুসলমান কৃষক জমিদার শ্রেণির নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবে। তিনি সব সময় স্বাধীনতার আন্দোলনকে শুধু ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার সংগ্রাম হিসেবে দেখেননি, তিনি এটাকে দেখেছেন নির্যাতিত দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম হিসেবে। তার জাতীয়তাবাদের ধ্যানধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সুষম সমাজব্যবস্থার চিন্তা। বাঙালির জাতিসত্তার স্বীকৃতির আন্দোলনকে তিনি সব সময় দেখেছেন একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে, শোষিত–বঞ্চিত মানুষের মুক্তির আন্দোলন হিসেবে। আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখছেন-

‘শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় নাই। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান পূর্বে ছিল খান সাহেব, খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীদের হাতে, আর এদের সঙ্গে ছিল জমিদার, জোতদার শ্রেণির লোকেরা। এদের দ্বারা কোনো দিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হতো না। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব যদি বাংলার যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় না করতে পারতেন এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণিতে টেনে আনতে না পারতেন, তা হলে কোনো দিনও পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত না।’

লাহোর প্রস্তাব যখন ১৯৪৬ সালের মুসলিম লীগ কনভেনশনে পরিবর্তন করা হলো এবং দুটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বদলে শুধু একটি রাষ্ট্রের কথা প্রস্তাবিত হলো, সেই পরিবর্তন সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীতে লিখছেন যে তখন তাদের বলা হয়েছিল যে কাউন্সিলের প্রস্তাব পরিবর্তন করা হয় নাই, এটা কনভেনশনের প্রস্তাব। এরপর ১৯৪৭ সালে সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎবসুর উদ্যোগে বাংলাকে ভাগ না করে যুক্ত বাংলার উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন সেই উদ্যোগের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধু যুক্ত ছিলেন। এক পাকিস্তান সৃষ্টি নিয়ে তার মনে যে প্রশ্ন এবং পরবর্তীতে যুক্ত বাংলার উদ্যোগের সঙ্গে তার যুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা থেকে বোঝা যায় যে বঙ্গবন্ধু ছাত্র অবস্থা থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূজারী ছিলেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তিনি কারাবরণ করেন। তবে সে সময় তিনি যে শুধু ভাষার অধিকার নিয়েই সংগ্রাম করেছেন তা নয়, গরিব এবং নির্যাতিত মানুষের পাশে থেকে অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদী আন্দোলনে যোগ দেন, যেমন কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে, জিন্নাহ ফান্ডের বিরুদ্ধে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের সমর্থনে।

কিন্তু তিনি তো ছিলেন মুসলিম লীগে। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হল কেন? গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তীব্র ছিল। বাঙালি জাতি সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের তুলনায় শিক্ষায় ও রাজনৈতিক সচেতনতায় অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু মুসলিম লীগ ক্রমেই শাসক পশ্চিম পাকিস্তানীদের ধামাধরা হয়ে উঠেছিল। তিনি গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তার আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন তা হলো: ‘আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নেই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে…বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।’

এরপর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৫৫ সালে কাউন্সিল সেশনে আওয়ামী লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি অপসারণ করা হয় যা এই উপমহাদেশে ধর্মনিরেপক্ষতার একটি মাইলফলক। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী জোটের একজন সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম দফা ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন এবং বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া। ১৯৫৫ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। গণপরিষদের এক বক্তৃতায় তিনি বাঙালির স্বকীয়তা এবং বাঙালিদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া জোরালোভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন: ‘ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য।…বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কী হবে? যুক্ত নির্বাচনী এলাকা গঠনের প্রশ্নটারই কি সমাধান? আমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কেই বা কী ভাবছেন?…আমার ওই অংশের [পশ্চিম পাকিস্তান] বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাব যে আমাদের জনগণের রেফারেন্ডাম অথবা গণভোটের মাধ্যমে দেয়া রায়কে মেনে নেন।’

‘কারাগারের রোজনামচা’য় বিভিন্ন জায়গায় তিনি অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কুফল সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। গণতান্ত্রিক উপায়ে বিরোধী রাজনীতি না করতে পারলে যে দেশ সন্ত্রাসী রাজনীতির দিকে অগ্রসর হতে পারে, তার আশঙ্কাও তিনি প্রকাশ করেছেন। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার দুর্ভাবনার কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখছেন: ‘খবরের কাগজ এসে গেল। দেখে আমি শিহরিয়া উঠলাম, এ দেশ থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ চিরদিনের জন্য এরা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে। জাতীয় পরিষদে ‘সরকারি গোপন তথ্য আইন সংশোধনী বিল’ আনা হয়েছে। কেউ সমালোচনামূলক যে কোনো কথা বলুন না কেন মামলা দায়ের হবে। … বক্তৃতা করার জন্য ১২৪ ধারা ৭(৩)…এবং ডিপি আর রুল দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মোটমাট পাঁচটি মামলা আর অন্যান্য আরো তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।…আমার ভয় হচ্ছে এরা পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির দিকে নিয়ে যেতেছে। আমরা এ পথে বিশ্বাস করি না।…আমরা যারা গণতন্ত্রের পথে দেশের মঙ্গল করতে চাই, আমাদের পথ বন্ধ হতে চলেছে।’ সম্ভবত তিনি কমিউনিস্ট শাসনকে অগণতান্ত্রিক মনে করতেন। তাই কমিউনিস্টদের সঙ্গে তার সম্পর্ক চিরকালই গন্ডীবদ্ধ ছিল। তবে তিনি যে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন তা তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। তার আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখছেন: ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই, তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যত দিন দুনিয়ায় থাকবে, তত দিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।’ সমাজতন্ত্র বলতে তিনি প্রাধানত শোষণমুক্ত এবং বৈষম্যহীন একটা ব্যবস্থার কথা ভাবতেন। ১৯৫২ সালে চীন যাবার পর চীন এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে পার্থক্য তিনি দেখেছেন, তা তার মনে গভীর দাগ কেটেছে। এই দুই দেশের পার্থক্য সম্বন্ধে তিনি লিখছেন: ‘তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ ও এ দেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন।’

তিনি ছিলেন চূড়ান্ত মানবদরদী। তিনি লিখছেন: ‘ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হয়েছে। আজ চীন দেশ কৃষক–মজুরের দেশ। শোষক শ্রেণি শেষ হয়ে গেছে।’স্বাধীনতার পর তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় তিনি কোনো বৈষম্য দেখতে চাননি। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন: ‘বাংলাদেশে মানুষে মানুষে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এত দিন ধরে বিরাজ করছিল, সেটা দূর করতে হবে।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে এক জনসভায় তিনি বলেন: ‘আমি কী চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসেখেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণভরে হাসুক।’

কাজেই বঙ্গবন্ধুর মনের মানচিত্রে যে ধারনার ভাঙচুর প্রতিনিয়ত হয়েছে তা দেখতে পাই। শুরুতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উন্নতির জন্যে কাজ করা এই নেতা শেষ অবধি তার ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছেন। একাধারে গণতন্ত্রের পূজারী হয়েও কমিউনিজমের ভাল দিক নিয়ে বলতে দ্বিধা করেন নি। যদিও নিজে সেই পন্থাকে সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি ছিলেন জনতার নেতা। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই তিনি সামনের দিকে, প্রগতির দিকে নিতে চেয়েছেন। সব বিষয়ে তিনি শেষ ভরসা করতেন মানুষের ওপরে। বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিংবা অন্য তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তিনি ঠিকই জানতেন জীবনে তার এই জনসংযোগ কতটা অমূল্য। এহেন বঙ্গবন্ধু কেন তবে বাকশাল আনলেন যা হয়ে উঠল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত রাজনৈতিক রূপকল্প ?